বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন বলতে কী বুঝ? বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের একজন সদস্য হিসেবে আবুল হোসেনের দর্শন আলোচনা কর।

অথবা, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন কী? বাংলাদেশ দর্শনের অগ্রযাত্রায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের
একজন সদস্য হিসেবে আবুল হোসেনের অবদান কতটুকু? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : উনিশ শতক পৃথিবীর ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সময়। এ সময়েই পাশ্চাত্য জগৎ মুক্ত হয়েছিল সবধরনের কুসংস্কার থেকে। ফলে মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ ও উদারতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু হয়। পাশ্চাত্যের এ অগ্রযাত্রার ছোঁয়া প্রাচ্যেও লাগে। এরই ধারাবাহিকতায় বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর পৌরহিত্যে৷ ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি প্রগতিশীল সংগঠন গড়ে উঠে। এ সংগঠনের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন আবুলহোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ, আব্দুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন : বুদ্ধির মুক্তি বলতে বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত হয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করার জন্য বাংলার ইতিহাসে যে সংগঠনটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটি হচ্ছে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। এ সংগঠনটি বাঙালি মুসলিমদের মুক্তবুদ্ধি চর্চার একটি জায়গা করে দেয়। ১৯২৬ সালে কাজী আব্দুল ওদুদ, কবি আব্দুল কাদির, আবুল হোসেন, ড. কাজী
মোতাহার হোসেন প্রমুখের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ গড়ে উঠে। এ সাহিত্য সমাজের সদস্যরা বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত হয়ে উদারনৈতিক চিন্তাধারার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের উন্নয়নে ব্যাপকভাবে চেষ্টা করেন। এ সাহিত্য সমাজের একটি মুখপত্র ছিল যেটি বছরে একবার করে প্রকাশিত হতো। এ মুখপত্রটি ছিল একটি সাহিত্য পত্রিকা, যা একসঙ্গে সাহিত্য রসিকদের পিপাসা মিটাত এবং গূঢ় দর্শনানুরাগীদেরও প্রয়োজন মিটাত। এ আলোচিত পত্রিকাটির নাম৷ ‘শিখা’, যার প্রতিটি সংখ্যার শিরোনামের নিচে লেখা থাকত, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।” এই পত্রিকার লেখকরা ‘শিখাগোষ্ঠী’ নামেও পরিচিত ছিলেন। সুতরাং বলা যায়, শিখাগোষ্ঠীর সদস্যরা বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর ছত্রছায়ায় যে প্রগতিশীল দার্শনিক আন্দোলন গড়ে তোলেন তাই বাংলাদেশ দর্শনে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ দর্শনে আবুল হোসেনের অবদান : প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী লেখক দার্শনিক আবুল হোসেন ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম কর্ণধার। তিনি সবরকম কুসংস্কার থেকে মনকে মুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে চিন্তা করে বাঙালি মুসলমানদের উন্নতির দিকনির্দেশ করেন। মুক্তবুদ্ধি ও উদার চিন্তার অধিকারী আবুল হোসেন ছিলেন এদেশের
অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। নিম্নে বাংলাদেশ দর্শনে তাঁর অবদান বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো :
১. যুক্তিবাদিতা : আবুল হোসেন অন্ধভাবে শাস্ত্রানুগত্য হয়ে কোন কাজ করার বিরোধী ছিলেন। তিনি যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সত্যকে গ্রহণ করতে বলেন। তিনি ধর্মীয়, সামাজিক প্রতিটি বিষয় বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রহণ করার পক্ষে মত দেন। বিচারহীন চিন্তাচেতনা কখনও কোন সুফল বয়ে আনতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। যুক্তিপূর্ণভাবে
চিন্তা করতে গেলে প্রথমে দরকার হয় বুদ্ধির মুক্তি। তাই আবুল হোসেনসহ অন্যান্য প্রথিতযশা তৎকালীন প্রগতিশীল কিছু
দার্শনিক ‘শিখা’ নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন, যার প্রতিটি সংখ্যার শিরোনামের নিচে লেখা থাকত, “জ্ঞান
যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।” তাঁরা যথাসম্ভব জ্ঞান অর্জনের পক্ষে যুক্তি দেন। কারণ যথার্থ জ্ঞান মানুষকে যুক্তিবাদী হতে শেখায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের (বাঙালি মুসলিম সমাজের) যুগ যুগান্তরের আড়ষ্ট বুদ্ধিকে মুক্ত করে জ্ঞানের অদম্য পিপাসা জাগিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু তাতো রাতারাতি হওয়া অসম্ভব। এসব দার্শনিকদের প্রধান উদ্দেশ্য মুক্তচিন্তার চর্চা এবং জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা ও রুচি সৃষ্টি এবং তদুদ্দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নবীন পুরাতন সর্বপ্রকার চিন্তা ও জ্ঞানের সমন্বয় ও সংযোজন সাধন। তিনি একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইসলামের প্রচলিত সকল নীতিকে গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি প্রচলিত
নিয়মকানুনের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এ কারণেই তিনি বলেছেন, “অন্যান্য ধর্মের ন্যায় ইসলামও কতকগুলো আদেশ ও নিষেধের সমষ্টি মাত্র। ইসলাম মানুষের জন্য, মানুষ ইসলামের জন্য নয়। কালের পরিবর্তনে অবস্থার বিপর্যয়ে ধর্মশাস্ত্রের কথা মানুষ পুরোপুরি পালন করতে পারে না এবং যেহেতু সংসারের উন্নতির জন্যই মূলত ধর্ম বিধানের সৃষ্টি সেহেতু ধর্মগুরুর আদেশের নিগ্রহ হতে মুক্তি না পেলে মুসলমানতো মানুষ হবেই
না, বরং ইসলামও কেবল Dead Letter হয়েই থাকবে।” এভাবে আবুল হোসেন ইসলামের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং স্বদেশ, স্বজাতির উদ্দেশে ইসলামের যুক্তিনিষ্ঠ স্বরূপ উপস্থাপন করেন।
২. উদারতাবাদ : আবুল হোসেন একজন উদারতাবাদী দার্শনিক ছিলেন। কোন ধর্ম, বর্ণ বা জাতির কোন বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি কোনকিছুর ব্যাখ্যা করা বা দেখা পছন্দ করতেন না। তাঁর মতে, বিশ্বের সবাই মানুষ। তাই যার কাছে যা ভালো আছে তা আমাদের গ্রহণ করা উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন, তা না হলে আমরা জাতি হিসেবে অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ব। এ কারণে তিনি ব্রিটিশদের উদার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ইংরেজ বণিকদের সাথে ইউরোপের জ্ঞানদীপ্ত মন যখন এদেশে আসলো এবং আমাদের আড়ষ্ট মনকে আঘাত করল তখন হিন্দু ভাইয়েরা তা সাদরে গ্রহণ করল, আর এ কারণে তারা আজ শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত। আর ইউরোপীয় জ্ঞানালোককে কূপমণ্ডূকতার কারণে গ্রহণ না করায় বাঙালি মুসলমানরা আজও পশ্চাৎপদ।
এভাবে আবুল হোসেন তাঁর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যে কোন ভালো কিছুকে গ্রহণ করেন এবং যা কিছুই খারাপ সবকিছুকে বর্জন করেন।
৩. মানবতাবাদ : বাংলাদেশ দর্শনের অন্যান্য দার্শনিকের মতো আবুল হোসেনও তাঁর দার্শনিক চিন্তায় মানবতাবাদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নাম হলেও এটি শুধু মুসলমানদের সংগঠন নয়, এখানে সকল ধর্মের প্রগতিশীল ব্যক্তির স্থান রয়েছে। তিনি বলেছেন, মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্দেশ্য হলো বাঙালি
মুসলমানদের উন্নত করা। তিনি চেয়েছিলেন সমস্ত বাঙালি জনগণের উন্নতি। তাই তিনি লক্ষ্য করলেন বাঙালি হিন্দুরা শিক্ষিত এবং মুসলমানরা অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ। তাই সমগ্র বাঙালি জাতির উন্নয়নে মুসলমানদেরও উন্নত করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, মুসলমানদের উন্নয়নে শুধু শিক্ষিত মুসলমানরাই এগিয়ে আসলে হবে না; শিক্ষিত হিন্দুসমাজও এ কাজে সহায়তা করবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “মুসলিম সাহিত্য সমাজ কোন একটি বিশিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়, কিংবা এ কোন এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য গঠিত হয়নি।” মানবকল্যাণে আবুল হোসেনের ভাবনা ছিল উপযোগবাদী। আবুল হোসেন যদিও নিজে কমিউনিস্ট ছিলেন না তবুও তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। তিনি সমাজের কৃষক, দিনমজুর থেকে সর্বস্তরের মানুষের মঙ্গল কামনা করেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম বিশিষ্ট দার্শনিক আবুল হোসেন একজন প্রগতিশীল যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সমাজের সমস্যাগুলো পর্যালোচনা করে এর সুষ্ঠু সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী এবং উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তী বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিকদের চিন্তাচেতনায় গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। তাই এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশ দর্শনের দার্শনিক হিসেবে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা অতুলনীয়।