বিদ্রোহী ও মানবতাবাদী হিসেবে নজরুলের মূল্যায়ন কর।

অথবা, নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা ও মানবতাবদের বিবরণ দাও।
অথবা, নজরুলের বিদ্রোহী ও মানবতাবাদী চরিত্রের বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : পৃথিবীর অনেক দার্শনিক আছেন যাঁদের দার্শনিক চিন্তাধারার সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা নেই। তাঁদের দার্শনিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন কাব্যে, গানে, উপন্যাসে ও নাটকে। এ প্রেক্ষাপটে কবি ও
শিল্পী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা যায়। যুগমন্ত্রণার সার্থক প্রতিফলন নজরুল কাব্যে মূর্ত হয়েছে। তাঁর গান ও কবিতায় তিনি যুগপৎভাবে বিভিন্ন যুগের, বিভিন্ন দেশের জনজীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সামনে টেনে এনেছেন এবং নিজেকে আঞ্চলিকতার সীমা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিকতার ব্যাপক পরিসরে টেনে নিয়েছেন। সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত মানবাত্মার মুক্তির লক্ষ্যে তিনি তাঁর সৃজনশীল
প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন।
বিদ্রোহী ও মানবতাবাদী হিসেবে নজরুল : নজরুল তাঁর অমর সৃষ্টিতে দেখাতে চেয়েছেন সমাজের জন্য মানুষ নয়; বরং মানুষের জন্য সমাজ। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মানবতার কল্যাণ সাধনের নিমিত্তে তিনি বিদ্রোহী
মনোভাব পোষণ করেন। নিম্নে তাঁর বিদ্রোহী ও মানবতাবাদী দর্শন তুলে ধরা হলো :
১. বিদ্রোহী মনোভাবের সূত্রপাত : বাল্যকাল হতেই নজরুল ইসলামের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। কোনো কাজেই তিনি পুরোপুরি মন বসাতে পারতেন না। তাই ছোটবেলায় স্কুল ছেড়ে রুটির দোকানে চাকরি নেন। যৌবনকালে যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিদেশি শাসনের গ্লানি, বঙ্গভঙ্গ, খেলাফত আন্দোলন প্রভৃতি তাঁর চিন্তাচেতনায় প্রভাব বিস্তার করে। এগুলোই তাঁর মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব জাগ্রত করে।
২. আত্মশক্তি ও বিদ্রোহী চেতনা : নজরুল একজন বিদ্রোহী মানুষ। তিনি ছিলেন আত্মশক্তিতে বলীয়ান। তাঁর লেখার মাধ্যমে ফুটে উঠে তাঁর আত্মশক্তি ও বিদ্রোহী চেতনা। তিনি ‘সংকল্প’ কবিতায় লিখেছেন-
“থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।”
৩. বিদ্রোহী মনের পরিচয় : বিদেশি শাসন, শোষণের ফলে দেশের মানুষ কিভাবে নিষ্পেষিত হয় তা তিনি ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেন বিদেশি শাসন, শোষণের বিরুদ্ধে। তিনি তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বলেন-
“আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
৪. বাঙালিকে সক্রিয় হওয়ার উদাত্ত আহ্বান : নজরুল বাঙালিকে তার গতানুগতিক জড়তা, আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে সচল ও সক্রিয় হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি শুধু প্রতিবাদী নন, তিনি ছিলেন আত্মনিষ্ঠাবান। তিনি বলেছেন, আমার কর্ণধার আমি। স্রষ্টা ও সৃষ্টির নিবিড় সম্বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন,
“আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজয় অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুৰ্জ্জয়”
৫. নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর বিজয় : নজরুল গরিব ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই গরিব মানুষের দুঃখদুর্দশা মর্মে
মর্মে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি তাঁর ‘রুদ্র মঙ্গল’ গ্রন্থে বলেছেন, “জাগো জনশক্তি! হে আমার অবহেলিত পদপিষ্ট কৃষক, আমার মুটে মজুর ভাইরা। আনো তোমার হাতুড়ি, ভাঙ্গো ঐ উৎপীড়কের প্রাসাদ, ধুলায় লুটাও অর্থপিশাচ বলদর্পীর শির।” নজরুল ইসলাম নিপীড়িত জনশক্তির বিজয় ও মুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী। তাই তিনি বলেছেন,
“ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডংকা শংকা
নাহি আর।
মরিয়ার মুখে মারণের বাণী
উঠিছে মার মার ৷
শত শতাব্দী ভাঙ্গে নি যে হাড়, সেই
হাড়ে উঠে গান
জয় নিপীড়িত জনগণ জয়!”
৬. ভাববাদী মানসিকতা ও রোমান্টিকতা : প্রধানত বিদ্রোহী মনের অধিকারী হলেও নজরুলের কবিতায় ভাববাদী মানসিকতা ও রোমান্টিকতার কমতি নেই। কারণ প্লেটো, রবীন্দ্রনাথের মত ভাববাদীদের ন্যায় নজরুলও সুন্দর, কল্যাণ ও প্রেমের আদর্শের অনুসারী। এ মহৎ আদর্শের লক্ষ্যেই নিবেদিত তাঁর চিন্তাচেতনা, ধারণা তথা সমগ্র কর্মকাণ্ড।
৭. বাস্তববাদী মানসিকতা : নজরুল জ্ঞানের খাতিরে জ্ঞানচর্চা, সত্যের খাতিরে সত্যানুসন্ধান এককথায় কলা কৈবল্যবাদের বিরোধী। কোনো দূরবর্তী আদর্শ নয়, চোখের সামনের বাস্তবতাই তাঁর ধ্যানধারণা ও কাব্য সাধনার মূল উপজীব্য। তাই তিনি ভাবাবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেন, “বড় কথা বড় ভাব আসেনাকো মাথায়, বন্ধু, বড় দুঃখে।
অমর কাব্য তোমরা লিখিও বন্ধু, যাহারা আছ সুখে।”
৮. অসাম্প্রদায়িক মনোভাব : নজরুলের মতে, “ধর্মের কথাই বলি আর দর্শনের কথাই বলি, সর্বত্রই মানুষ বিবেচিত হয় মানুষ হিসেবে। শোষিত, অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানব অস্থিও উদ্দাম হয়ে উঠেছে।” তাঁর মতে, মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে অনৈক্য দুঃখজনক। তাই কবি তাঁর সাম্যবাদী কাব্যে বলেছেন—
“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।
যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।”
৯. সাম্যবাদ : এ উপমহাদেশে সাম্যবাদ তথা মানবতাবাদ স্ফুরিত ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছিল নজরুল ইসলামের বিভিন্ন কাব্যে, সাহিত্যে, গানে ও অভিভাষণে। তিনি সমস্ত মানুষকে এক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ভাবতে চেয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবীকে একদেশ হিসেবে। ফলে তিনি হয়েছিলেন বিশ্বনাগরিক।
১০. ধর্মীয় মানবতা : নজরুল ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সকল ধর্মের, সকল মানুষের
মুক্তির দিশারী । তিনি ধর্মের নৈতিক দিক যা সর্বজনীন মানবতাবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, তারই উপাসক । তিনি বলেন,
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়
কে দেয় সেখানে তালা
চালা হাতুড়ি শাবল চালা।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, কাজী নজরুল ইসলাম সত্য, সুন্দরের পূজারি। তিনি কখনই ন্যায়, সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে পিছপা হননি। সারাবিশ্ব যখন মানবাধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করছে তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। এভাবেই তিনি তাঁর বিদ্রোহী চেতনা
সূক্ষ্ম মানবতাবাদী দর্শনের মাধ্যমে বিশ্ব ইতিহাসে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন।