অথবা, বিচ্যুতিমূলক অপসংস্কৃতি তত্ত্ব কী? এ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে জনসাধারণ গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আস্থা প্রকাশ করছে। সকলেই ভাবছে গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভবত মানবতার মুক্তি। কিন্তু সমাজের উঁচুতলার কিংবা শাসকশ্রেণী সেভাবে মানুষের মুক্তি কামনা করছে না। তারা গণতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, কিন্তু জনকল্যাণমূলক কাজ না করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছে। এ ক্ষমতাশালী স্বার্থবাদী শ্রেণীর উদ্দেশ্য ও চিন্তা হচ্ছে কেবলমাত্র নিজেদের উন্নতি। অপরের ক্ষতিসাধন করতেও এ স্বার্থপর শ্রেণী দ্বিধান্বিত হয় না। সমাজের ক্ষমতাসীনদের এরূপ শোষণের ফলে অনেকেই বিচ্যুতিমূলক আচরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিচ্যুতিমূলক উপসংস্কৃতি তত্ত্ব (The sub-culture theory of deviance) : বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য সাংস্কৃতিক কারণ বিরাট ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি সমাজেই একটি সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি রয়েছে। সমাজের সদস্যরা উক্ত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা বা অন্য সমাজের সাংস্কৃতিক প্রভাবে উপসংস্কৃতি বা Sub-culture গড়ে উঠে। উপসংস্কৃতির সৃষ্টির ফলে সমাজস্থ ব্যক্তি আর নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করতে পারে না। সংস্কৃতির পরিপন্থী এবং সামাজিক অনুশাসনের বাইরে বের হতে উপসংস্কৃতি তাকে উৎসাহিত করে। সামাজিক বিচ্যুতির জন্য উপসংস্কৃতিকে দায়ী মনে করে বিচ্যুতি সংক্রান্ত যে তত্ত্ব প্রদান করা হয় তাকে Sub-culture theory বলে। এ মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা হলেন Albert Cohen, পরবর্তীতে রিচার্ড ক্লোওয়ার্ড এবং লয়েড ওলিন এ তত্ত্ব সম্পর্কে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এ তাত্ত্বিকদের মতে, Sub-culture বা উপসংস্কৃতি অপরাধের বিস্তার ঘটায়। সমাজে নির্দিষ্ট রীতিনীতি থাকার পাশাপাশি এসব যাতে সবাই মেনে চলে তার জন্য রয়েছে আইন আদালত। কিন্তু উপসংস্কৃতি এসব অমান্য করায় প্রভাবিত করে বিচ্যুতি বা অপরাধ সংঘটিত করে। সমাজের প্রত্যেক সদস্যই একই রকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করে না। সমাজের চাহিদা পূরণের ব্যর্থতা থেকে অনেক সময় বিচ্যুতির জন্ম হয়। সমাজের বঞ্চিত শ্রেণী নিজেদের হতাশা থেকে বিচ্যুতিমূলক আচরণে জড়িত হতে পারে। বিচ্যুতির এ প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যক্তিকে অপরাধী করে তোলে। ব্যক্তির যে চাহিদা তা সমাজ পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যক্তি অন্য সমাজ বা সংস্কৃতির উপাদানসহ বঞ্চিতদের নিয়ে একটি উপসংস্কৃতি গড়ে তোলে। বর্তমান সময়ে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণ হচ্ছে। এতে করে একটি Culture অপর একটি Culture কে সহজেই প্রভাবিত করতে পারছে। মানুষ অন্য সংস্কৃতিকে অনুসরণ করার ফলে তার নিজস্ব Culture এর অবনতি হয়। ফলশ্রুতিতে Sub-culture এর সৃষ্টি হয় এবং ব্যক্তিকে বিচ্যুতিমূলক আচরণে সম্পৃক্ত করে। অনুকরণ করার মানসিকতাই হলো Sub-culture সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ।
নিজের সংস্কৃতি থেকে অপর সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগের ফলেই Sub-culture এর সৃষ্টি হয়। এ নতুন উপসংস্কৃতি গড়ে উঠার ফলে ব্যক্তির যে চাহিদা সৃষ্টি হয় তা প্রচলিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ মিটাতে অসমর্থ হয়। অপরদিকে, বিভিন্ন অসুবিধার কারণে নতুন প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। ফলে ব্যক্তি তার চাহিদামতো জীবনযাপন করতে না পেরে স্বাভাবিক জীবন থেকে সরে গিয়ে ডেভিয়ান্ত হয়ে যায়। নিজস্ব সংস্কৃতিকে ঠিকভাবে লালন না করার ফলেই ব্যক্তির বিচ্যুতি বৃদ্ধি পায় বলে তাত্ত্বিকরা মত প্রকাশ করেছেন ।
Sub-culture বা উপসংস্কৃতিকে তাই বিচ্যুতি ও অপরাধের জন্য দায়ী করা যায়। কারণ সমাজের প্রচলিত Norms, Values কিংবা Mores তথা Expectations এর বিরুদ্ধে মনোভাব তৈরির জন্য Sub-culture ই দায়ী। তাই বিচ্যুতির আচরণ ব্যাখ্যায় Sub-culture theory গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচ
না শেষে বলা যায় যে, সমাজ প্রতিনিয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ায় মানুষের মাঝে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু অতিরিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনোভাব মানুষের স্বার্থপরতা বৃদ্ধি করছে। নিজেকে সকলের। ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।অপরের ক্ষতিসাধনও এখন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে যার শক্তি ও ক্ষমতা বেশি তার আচরণেই বেশি অমানবিকতা প্রকাশ পাচ্ছে। ক্ষমতাবান ব্যক্তির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলেই তা সমাজ বিরোধী ও বিচ্যুতিমূলক আচরণ বা অপরাধ বলে গণ্য করে শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। ফলে তথাকথিত বিচ্যুতিকারী ব্যক্তি আরো বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে।