অথবা, বাংলাদেশে বেকার সমস্যা সমাধানের সুপারিশ কর।
অথবা, কীভাবে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধান করা যায়? আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে বেকার সমস্যা সমাধানের উপায় বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশসমূহে অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা হচ্ছে বেকার সমস্যা। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বেকার সমস্যাকে বাংলাদেশেও একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে জনসংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু সে তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ইতোমধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ জনশক্তি বেকার হয়ে পড়েছে। তাই বেকারত্ব কি এবং বেকারত্বের কারণ এবং এর প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে জানা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
বেকারত্ব সমস্যা দূরীকরণের উপায়সমূহ : বাংলাদেশে যেমন একক কোনো কারণে বেকার সমস্যা সৃষ্টি হয় না, তেমনি এককভাবে বেকার সমস্যা দূর করা যায় না। তাই সমস্যা দূরীকরণের বিভিন্ন উপায় যা নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. দ্রুত শিল্পায়ন : বেকার সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে শিল্পায়ন। বেকার, সমস্যা সমাধানকল্পে দেশে শিল্পায়ন আবশ্যক। দেশে অধিকসংখ্যক কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারলে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে বেকার লোক এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পাবে।
২. কৃষিব্যবস্থার আধুনিকীকরণ : যে সনাতন পদ্ধতি বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থায় বিদ্যমান একে তা থেকে আধুনিকীকরণে উন্নতি করতে হবে। কৃষিজমিতে যেখানে একবারমাত্র ফসল উৎপাদিত হতো সেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে বছরে সেখানে দু’তিন ফসল উৎপন্ন করে কৃষকদের মৌসুমি বেকারত্বকে দূর করা সম্ভব।
৩. ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উন্নয়ন : ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উন্নয়ন এবং সেগুলো সম্বন্ধে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে কৃষকরা ঘরে বসে অবসর সময়ে বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারে এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে ।
৪. কারিগরি জ্ঞান বৃদ্ধি : দেশে কারিগরি ও প্রকৌশলগত জ্ঞান সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। এ উদ্দেশ্যে দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ কারিগরি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সেখানে শ্রমিকদের উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
নারী শিক্ষার প্রসার : দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তারা অধিকাংশই বেকার। কারণ তাদের মধ্যে বিভিন্ন কাজের উপযুক্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। দেশের এ বৃহৎ অংশের বেকারত্ব দূর করতে মহিলাদের মধ্যে সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে এবং তাদের জন্য উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে।
৬. শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাংলাদেশের বেকার সমস্যা দূর করতে হলে দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার আরও ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে পারলে বেকারত্ব অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
৭. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি রোধ করতে পারলে বেকার সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। এ উদ্দেশ্যে জনমনে পরিবার পরিকল্পনা সুফল প্রবেশ করিয়ে জনসংখ্যার বৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হবে। তবেই বেকার সমস্যা সমাধান করতে বাংলাদেশের আর তেমন কোনো বেগ পেতে হবে না।
৮. বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ : বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে আমাদের শ্রমশক
্তির জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকগণ বিদেশে যাতে নিয়োগ লাভ করতে পারে সে উদ্দেশ্যে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৯. ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : বাংলাদেশে বেকার সমস্যা বিশেষ করে বৃহৎ বেকার গোষ্ঠী নারীদের বেকারত্ব দূর করতে সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে মেয়েদের ধর্মীয় কুসংস্কার, বাধ্যতামূলক গৃহিণী থেকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও কাজের সুযোগ দিতে হবে।
১০. কর্মবিনিময় কেন্দ্র স্থাপন : চাকরির সুযোগ সুবিধা ও আনুষঙ্গিক তথ্য সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় আমাদের দেশে বহু লোক বেকার থাকছে। তাই দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মবিনিময় কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে তাদেরকে সচেতন করলে বেকারত্ব কমানো যেতে পারে।
১১. শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি : বাংলাদেশে শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শ্রমের গতিশীলতা বৃদ্ধি করতে পারলে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
১২. রপ্তানিমুখী শিল্পের ব্যাপক সম্প্রসারণ : বিদেশে যেসব দ্রব্য রপ্তানি করা যায়, সেসব দ্রব্য উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে। এ শিল্পের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে সে মুদ্রা আবার
অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরিতে নিয়োগ করতে হবে। এর ফলে দেশে শিল্পকারখানা বৃদ্ধি পাবে এবং বেকার সমস্যা দূর হবে।
১৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করলে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগে উৎসাহের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে দেশি বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের আকৃষ্ট করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে।
১৪. সরকারের সহযোগিতা : বিভিন্ন কাজে উৎসাহ প্রদানের জন্য বেকার যুবকদের পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান এবং তাদেরকে বিনা খরচে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার জন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়শীল দেশে মূলত অর্থনৈতিক সমস্যার কারণেই বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। এ বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্যে সরকারকে আন্তরিক এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সে সাথে জনগণকেও তাদের সমস্যা সমাধান ও ভাগ্য উন্নয়নের উদ্দেশ্যে সচেষ্ট হতে হবে। তবেই স্বনির্ভর জাতি হিসেবে
সৃষ্টি হবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ এবং বেকার সমস্যা নামে কোনো সমস্যা বাংলাদেশে থাকবে না।