বাংলাদেশে প্রান্তিক গোষ্ঠীর (উপজাতি) শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা দূরীকরণের উপায়সমূহ আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে প্রান্তিক গোষ্ঠীর শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা দূরকরণের পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, প্রান্তিক গোষ্ঠীর শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য দূরীকরণের উপায়সমূহ তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সকল সমাজে একটি বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠী আছে যারা নির্যাতিত হলেও চোখ বুজে সহ্য করে, যারা ক্ষুধার্ত হলেও খাদ্যের জন্যে হাত প্রসারিত করে না, যাদের হাহাকার নীরবে নিভৃতে কাঁদে। মূলত এ ধরনের সমস্যার মূলে রয়েছে শিক্ষাহীনতা। এসব সমস্যা দূরীকরণের প্রত্যয়ে ‘সর্বজনীন শিক্ষা চাই’ এ ধরনের শ্লোগান সবার মুখে মুখে
ভেসে উঠে। মূলত Sociology of Education এ ধরনের গোষ্ঠী বা শ্রেণিকে নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে।
উপজাতিদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা দূরীকরণের উপায় : উপজাতিদের শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমিত সম্পদ হওয়া সত্ত্বেও সরকার শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করছে। কিন্তু বেশকিছু উপজাতি গোষ্ঠী ছাড়া সকল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উপজাতিরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদেরকে যদি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যায় তাহলে দেশ ও জাতিরই মঙ্গল। উপজাতিদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা কিভাবে দূর করা যায় নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ক. মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান : মাতৃভাষায় খুব সহজেই ভাষা প্রকাশ করা যায়। তাই শিক্ষার জন্য মাতৃভাষা সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। আমাদের দেশে ১৮টির বেশি উপজাতীয় ভাষা থাকলেও দু’একটি ছাড়া অন্যান্য উপজাতীয় ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় না। উপজাতিদের যদি তাদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে তারা খুব সহজেই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাই উপজাতিদের শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথাটি বিশেষভাবে বিবেচনায় আনতে হবে।
খ. পাঠ্যসূচির সংস্কার সাধন : বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে যে পাঠ্যসূচি প্রচলিত আছে সেখানে উপজাতিদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সমাবেশ ঘটাতে হবে। প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাদের জীবন প্রবাহের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এভাবে তাদের মধ্যে শিক্ষিতের হার বাড়ানো যেতে পারে।
গ. বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ : উপজাতিরা স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র। তারা সামাজিক সুযোগ সুবিধা অপেক্ষাকৃতভাবে কম পেয়ে থাকে। তাদের সন্তানদের শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার জন্যে বিনামূল্যে শিক্ষাপোকরণ সরবরাহ করতে হবে। এতে করে অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলতে পারেন।
ঘ. পৃথক ছাত্রাবাস : উপজাতিদের জীবনধারা স্বাভাবিকভাবেই পৃথক। তাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপজাতীয় শিক্ষার্থীদের জন্যে পৃথক ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে তারা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
ঙ. ছাত্রবৃত্তি প্রদান : উপজাতিদের শিক্ষার সর্বস্তরে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে উপজাতীয় শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। তারা শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসবে।
চ. মাধ্যমিক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা : উপজাতীয় ছেলেমেয়েদের শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। এতে করে উপজাতীয়রা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।
ছ. উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোটা বৃদ্ধি : উপজাতিদের উচ্চ শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে কোটা বাড়ানো যেতে পারে। এতে করে তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে। উপজাতীয় গোষ্ঠী শিক্ষা লাভের মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
জ. উপজাতীয় শিক্ষক নিয়োগ : উপজাতিদের শিক্ষাবিস্তারের লক্ষ্যে উপজাতীয় যুবকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এতে করে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজের বাসগৃহ ভাবতে পারে। নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ, মননশীলতার বিকাশ এর মাধ্যমে সম্ভব।
ঝ. নতুন বিদ্যালয় স্থাপন : দেশের বেশিরভাগ উপজাতির বসবাস পাহাড়ি অঞ্চলে। তাই তাদের জন্যে পাহাড়ি অঞ্চল বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। এতে করে তাদের বিদ্যালয়ের পরিবেশ আপন গৃহের ন্যায় মনে হবে। মননশীলতার বিকাশ তারা বিদ্যালয়ে ঘটাতে সম্ভব হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে খুব বেশি দূরে না হয় তার জন্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যালয়ের অবস্থান চলাচলের সুবিধাযুক্ত হতে হবে।
ঞ. কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা : বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম রাষ্ট্রসমূহের অন্যতম। এখানকার উপজাতিরা সাধারণের তুলনায় আরও বেশি দরিদ্র। তাই উপজাতিদের শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে তাদের ছেলেমেয়েদেরও শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারবে। এভাবে তাদের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ ঘটবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষাকে বলা হয় উন্নয়নের চাবিকাঠি। শিক্ষার সংস্পর্শ ছাড়া কোন দেশ ও জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। তাই বলা হয় যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। কোন জাতি কতটা সভ্য তা যাচাইয়ের জন্যে একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে শিক্ষা গৃহীত হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। উপজাতিরা আরও বেশি সমস্যায় ভোগে। তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা দূর করার মাধ্যমে জাতিকে আরও এক ধাপ উপরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।