নগর এবং গ্রামীণ জীবন প্রণালির একটি আদর্শ নমুনা উল্লেখ কর।

অথবা, নগর ও গ্রামের বিপরীতমুখী সম্পর্ক বা মিথস্ক্রিয়ার একটি চিত্র অঙ্কন কর।
অথবা, নগর এবং গ্রামীণ জীবনযাপনের একটি নমুনা আলোচনা কর।
অথবা, গ্রাম ও শহরের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য তার একটি প্রতিরূপ তুলে ধর।
উত্তর ভূমিকা :
জনসংখ্যার আকৃতি এবং ঘনত্বের দিক থেকে মানব সম্প্রদায়কে পাড়া প্রতিবেশী, গ্রাম, শহর, অঞ্চল এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা যায়। আধুনিক সমাজের সবচেয়ে বড় পার্থক্যসূচক সংগঠন হচ্ছে গ্রামীণ ও নগর বা শহুরে সম্প্রদায়। গ্রাম প্রাচীনতম স্থায়ী মানব সমষ্টি। বোগারডাস (Emory. S. Bogardus) তাঁর The Development of social thought’ শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “Human society has been cradled in the rural group.” অর্থাৎ, গ্রামীণ গোষ্ঠী হচ্ছে মানবসমাজের সূতিকাগার।
নগর ও গ্রামের আদর্শ নমুনা (Indeal type of urban and rural life) : সামাজিক কোন প্রপঞ্চ (Phenomenon) পাঠে Max Weber আদর্শ নমুনার উপযোগিতা ব্যাখ্যা করেছেন। আদর্শ নমুনা বাস্তব ঘটনাশ্রয়ী নয়, তবে যুক্তিভিত্তিক। Louis wirth, Robert Redfield এবং অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানীদের মতামতের ভিত্তিতে নিম্নে নগর ও গ্রামীণ জীবন প্রণালির একটি আদর্শ নমুনা উল্লেখ করা হলো :
১. সম্প্রদায়ের আকার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব (Size of community and density of population) : নগরের তুলনায় গ্রামের আকার সাধারণত ছোট এবং জনসংখ্যার ঘনত্বও কম। প্রতি বর্গমাইলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা শহরের চেয়ে গ্রামে অনেক কম। কৃষিকাজ এবং পশুপালনের জন্য গ্রামে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভূমি বা মাঠ রয়েছে। শহর বা নগরে অধিকসংখ্যক মানুষকে অল্প পরিসরের মধ্যে বসবাস করতে হয়। তবে শহরগুলো সাধারণত বৃহদায়তন বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এছাড়া শহরাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে নারীর অনুপাতে পুরুষের সংখ্যা বেশ বেশি। কিন্তু গ্রাম এলাকায় নারী পুরুষের আনুপাতিক হারে এ রকম তারতম্য দেখা যায় না। এসব কারণে গ্রাম ও নগরে বসতির ধরন ও (Pattern of settlement) ভিন্নতর হয়ে থাকে।
২. সমজাতীয়তা এবং অসমজাতীয়তা (Homogeneity and heterogeneity) : একটা ক্ষুদ্র জনসম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে গ্রামের মানুষেরা সমান স্বার্থ ও প্রধান পেশাগুলো প্রতিনিয়ত মুখোমুখি সংস্পর্শের মাধ্যমে (through frequent face to face contacts) ভাগ করে নেয়। অন্যদিকে, শহরে রয়েছে অসমজাতীয় জনসংখ্যা। সেখানে নানা
শ্রেণি, গোষ্ঠী, পেশা, জাতি, বর্ণ ও ধর্মের মানুষ বাস করে।
৩. সাধারণ পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে পরিচিতি (General environment and orientation to nature) : ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে গ্রামীণ মানুষ জন প্রকৃতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। বৃষ্টি, তাপ, বনজঙ্গল, তুষার ও খরা প্রকৃতির এ উপাদানগুলোর উপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এখানকার মানুষের মধ্যে প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্বাস কাজ করে যা নগরবাসীর ঠিক বিপরীত যারা প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে অনেক দূরে।
৪. পেশা (Occupation) : গ্রামে কৃষিই প্রধান উৎপাদন পদ্ধতি এবং পেশা। গ্রামের প্রত্যেক পরিবারই আপন আপন কর্ম সম্পাদন করে। অপরপক্ষে, শহরে রয়েছে দক্ষ শ্রমিক, অদক্ষ শ্রমিক, কারিগর, বিভিন্ন অফিসের কর্মচারী, যন্ত্রবিদ, শিল্পী, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সমাজসংস্কারক প্রভৃতি।
৫. সামাজিক গতিশীলতা (Social mobility) : গ্রামীণ জীবনে সামাজিক সচ্ছলতার অভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। পক্ষান্তরে, নগর জীবনে সামাজিক সচ্ছলতার সুযোগ সুবিধা বিশেষভাবে বর্তমান থাকে। এ প্রসঙ্গে “Principles of Urban Sociology’ গ্রন্থে সরোকিন ও জিম্মারম্যান (Pritirim Sorokin and Carle C Zimmerman) অর্থাৎ, গ্রামীণ সম্প্রদায় গভীর জলাশয়ের স্রোতবিহীন অবস্থার সমতুল্য। অন্যদিকে, শহরে সম্প্রদায় একটি কেটলির ফুটন্ত জলের মতো। প্রথমটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়েছে স্থিতিশীলতা, আর দ্বিতীয়টির সচ্ছলতা।
৬. সম্প্রদায়গত চেতনা এবং সংহতিবোধ (Community sentiment and solidarity) : গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে সমষ্টিগত মানসিকতা ও সংহতিবোধ বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়। কিন্তু নগরের অধিবাসীদের মধ্যে এ চ েতনা অপেক্ষাকৃত কম। গ্রামীণ মানুষ একে অপরের ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে আসে। সবাই সবাইকে চেনে ও জানে। অন্যদিকে, বৃত্তির বিশেষীকরণ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ প্রভৃতি নগর জীবনের বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয় বিধায় সেখানে মানুষের মধ্যে সংহতিবোধ নেই বললেই চলে। বলা যায়, Then we feeling of the city-dweller is weakened by the very complexity of urban society.
৭. সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্বের ধরন (Social control and leadership pattern) : গ্রামীণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা এবং সামাজিক বন্ধন বর্তমান থাকে। তার ফলে গ্রামীণ জীবনে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি আরোপ হয়। অপরপক্ষে, নগর জীবনে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কার্যত অনুপস্থিত। নগরাঞ্চলের জীবনধারা নিয়ন্ত্রিত হয় আইন, আদালত, পুলিশ প্রভৃতি সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দ্বারা।
৮. জ্ঞাতি সম্পর্ক (Kinship) :
নগরের তুলনায় গ্রামে জ্ঞাতি সম্পর্ক খুবই দৃঢ়তর। গ্রামে বয়স বিচারে অনেকেই অপরিচিতকে কোন না কোনভাবে জ্ঞাতি সম্পর্ক গড়ে তুলে। গ্রামের মানুষ সবাই একে অপরের জ্ঞাতি। কিন্তু নগর জীবনে বৈবাহিক (স্বামী-স্ত্রীর সূত্রে) এবং রক্ত সম্পর্ক (যেমন- পিতা পুত্র) সূত্র ছাড়া জ্ঞাতি সম্পর্কের তেমন আর কোন রূপ দেখা যায় না।
৯. নারীর ভূমিকা (Role of women) : গ্রামীণ সামাজিক জীবনে মেয়েরা একঘেয়ে সংসার জীবনযাপন করে। কিন্তু পৌর জনসম্প্রদায়ের প্রভাবে নারীর চিরাচরিত ভূমিকার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে শিল্প সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার, বিশেষায়ন প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে নগর জীবনের মহিলাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভ্যাসে পরিবর্তন আসছে।
১০. সামাজিক সম্পর্কের প্রকৃতি (Nature of social relationship) : গ্রামের মানুষের যাবতীয় সম্পর্ক সীমাবদ্ধ থাকে তার পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী ও জ্ঞাতি গোষ্ঠীর মধ্যে এবং এ সম্পর্ক হলো প্রত্যক্ষ ও মুখোমুখি। পক্ষান্তরে, নগরের অধিবাসীদের মধ্যে মুখোমুখি পরিচয়ের অন্তরঙ্গতা থাকে না। তাদের সামাজিক সম্পর্ক যান্ত্রিক ও পরোক্ষ প্রকৃতির। এ প্রসঙ্গে বগার্ডাস ও হালবার্টের কথা উল্লেখ করা যায়। আবার জিস্ট ও হালবার্ট বলেছেন, “The city encourages impensonal rather than personalrelationships” (urban society) অর্থাৎ, গ্রামের মানুষ সহজ সরল, তারা শহর জীবনের কৃত্রিমতা অপছন্দ করে। আবার, নগরের অধিবাসীদের মধ্যে মুখোমুখি সম্পর্কের বা পরিচয়ের অন্তরঙ্গতা থাকে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে এটাই প্রমাণিত হয় যে, নগর এবং গ্রাম সমাজের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। তাই এ দু’টি সমাজের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বিপরীতমুখী সম্পর্ক বা মিথস্ক্রিয়া বিরাজ করে। নগর ও গ্রাম জীবনের কাঠামোগত তথা অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ জীবনের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য দু’টি সমাজকে পরস্পর বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করায়।