বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর উপর বিশ্বায়নের বহুমাত্রিক প্রভাব আলোচনা কর ।

অথবা, বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর উপর বিশ্বায়নের প্রভাব বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর উপর বিশ্বায়ন কী প্রভাব বিস্তার করেছে? আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর উপর বিশ্বায়নের প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
একবিংশ শতাব্দীর আলোচ্যবিষয় হলো বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন শব্দটি নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের উপর সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বায়ন শব্দটি বিশ্বজনীন বা সর্বজনীন। বিশ্বায়ন এর ধারণা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। বিশ্বায়নের ধারণা মৌলিক কোনো বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি জড়িত থাকতে পারে অর্থনেতিক ক্ষেত্রে,
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর উপর বিশ্বায়নের প্রভাব : বিশ্বায়নের ফলে উন্নত দেশগুলো বেশি মাত্রায় লাভবান হবে এবং উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর উপর বিশ্বায়নের বহুমাত্রিক প্রভাব নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. বিশ্বায়ন ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রভাব : বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ব্যাপক প্রভাব রাখছে। বিশ্বায়নের ফলে সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি এ সমাজে প্রধান, রাষ্ট্র ব্যবস্থা গৌণ। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর ঝোঁকে বেশি সামাজিক অনুশাসনের চেয়ে। পরিবার, আনুগত্য, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক, দেশাত্মবোধ সবক্ষেত্রে এই ব্যক্তির অভিরুচি প্রাধান্য পাচ্ছে, ঐতিহ্যবোধ বিলুপ্ত হচ্ছে। বিশ্বায়নের ফলে চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস, সংস্কারেও ধাক্কা পড়েছে, যুক্তি দিয়ে ফলপ্রসূতা দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে সামাজিক বিধিনিষেধ কতটুকু গ্রহণীয়। এতে আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুশাসনের বাধা ভেঙে কোনো ক্ষেত্রে প্রগতি সম্ভব হয়েছে আবার কোনো ক্ষেত্রে নৈরাজ্যও ঘটেছে।
২. বিশ্বায়ন ও শিক্ষা : বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে হলেও শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিদেশমুখিতা সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এক বিশেষ প্রভাব বিস্তার করছে। বর্তমানে বাণিজ্যায়নের প্রভাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে মানুষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে।
৩. বিশ্বায়ন ও মেধা : তৃতীয় বিশ্বের মেধাস্বত্ব তথা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির উপরও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়, যা বিশ্বায়নের প্রভাবেই সংঘটিত হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দ্রব্য ও প্রযুক্তির নমুনা নিয়ে নেয়। ফলে অন্য কোনো রাষ্ট্র তা উৎপাদন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
৪. বিশ্বায়ন ও সামাজিক বৈষম্য : বিশ্বায়নের প্রভাব বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বে সামাজিক ক্ষেত্রে সুদূর প্রভাব ফেলছে। সামাজিক খাতের বাণিজ্যায়ন ও ব্যক্তিগত কারণের ক্ষেত্রেও বিশেষ প্রভাব বর্তমান। সামাজিক খাতের পরিবর্তন বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অপরাধ প্রবণতা, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রভৃতি বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশের সমাজের দিকে তাকালেই এটা বুঝা যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও বিশ্বায়নের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বায়নের প্রভাবে সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫. বিশ্বায়ন দারিদ্র্য : ১৯৮৫-৮৬ সালে যখন বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন বাংলাদেশের ২০% দারিদ্র্য লোকের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৩১ আর ২০% ধনী জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ১০৮৫ ডলার। ১৯৯৫-৯৬ সালে দরিদ্র্যতম ২০% মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৫৭১ ডলার, আর ২০% ধন ী জনগণের আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৮৫ ডলার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের সুবিধা আদায় করতে পেরেছে কেবল ধনীরাই এবং ধনী গরিবের বৈষম্যও এতে করে বেড়ে গেছে।
৬. অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া : বিশ্বায়নের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। বলা হয় মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাপী পুঁজি পন্য, সেবা, শ্রম ও তথ্য প্রযুক্তির অবাধ বিচরণ হবে এবং উন্নয়ন হবে। কিন্তু দেখা যায় যে, পুঁজি ও পণ্য সহজে সঞ্চালন হয় কিন্তু শ্রম সঞ্চালন হয় না। আবার উন্নত দেশের বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজি ও পণ্য সকল দেশে অনুপ্রবেশ করলেও উন্নয়নশীল দেশ থেকে পুঁজি ও পণ্য উন্নত দেশের বাজারে প্রবেশ করে না। বিশ্বায়নের ফলে ধনী ও দরিদ্র দেশের ব্যবধান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৭. দেশীয় পণ্যের অসম প্রতিযোগিতা : বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ঠ মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বাংলাদেশ যেসব কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে তার মূল্য আসল মূল্যের চেয়ে বেশি ধরা হয়। এর অর্থ Over Pricing করা হয়। ফলে বাংলাদেশের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ে যায় এবং বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মার খায়। এভাবে
বহুজাতিক কোম্পানি Transfer Pricing এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে উদ্বৃত্ত পাচার করে।
৮. বিশ্বায়ন এবং কৃষি ও জ্বালানি ক্ষেত্র : বিশ্বায়নের ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শস্য, বীজ, সবজি ও ফলমূলের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করছে। বাংলাদেশের কৃষকগণ দীর্ঘকাল ধরে বীজ সংরক্ষণ করে আসছেন কিন্তু নিজস্ব বীজ সংরক্ষণ বন্ধ করে তাদেরকে বীজ ব্যবসায়ী কিংবা এনজিও এর উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অসমচুক্তি করার ফলে বাংলাদেশের মূল্যবান সম্পদ তেল ও গ্যাস অধিকহারে উত্তোলিত হয়ে বিদেশে বিক্রয়ের মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
৯. বিশ্বায়ন ও অপরাধ : বিশ্বায়ন অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।যেমন-অবাধ বাজার ব্যবস্থা মাদক দ্রব্য বাণিজ্যকে আরো বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি করেছে এবং আমাদের যুব সমাজ অধিক মাত্রায় আসক্ত হচ্ছে।
১০. নগরায়ণ ও বিবাহ বিচ্ছেদ এবং পরিবার ভাঙন : বিশ্বায়নের ফল স্বরূপ আমাদের দেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। মার এ নগরায়ণের ফলে মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয় যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে রূপ নিচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদও বেড়ে যাচ্ছে। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও সামাজিক অভিঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান যুগ আধুনিক ও বিশ্বায়নের যুগ। বিশ্বায়নের সামাজিক প্রভাব সব সময় মঙ্গলজনক নাও হতে পারে। আমাদের দেশে বিশ্বায়নের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় প্রকার ফলাফলই বিদ্যমান। শিক্ষা এবং সচেতনতার মাধ্যমে পরিস্থিতি উপলব্ধি করে বিশ্বায়নকে গ্রহণ করতে হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বায়নের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসালে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সকল ক্ষেত্রেই অপূরণীয় মূল্য দিতে হবে।