অথবা, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষিতে এ সমস্যাটি আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিজনিত সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিজনিত সমস্যা সৃষ্টির কারণ বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিজনিত সমস্যা সৃষ্টির কারণ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানবসমাজ সততই পরিবর্তনশীল। সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হলেও তা কখনই এক মাত্রা ও একই সময়ে হয় না। সমাজের কোনো ক্ষেত্রে দ্রুত আবার কোনো ক্ষেত্রে ধীর গতিতে এ পরিবর্তন সাধিত হয়। ফলে গোটা সমাজব্যবস্থায় একটা অসামঞ্জস্যতা বা ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন সমাজের এ পরিবর্তনকে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিজনিত সমস্যা : বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম একটি দেশ। এদেশের সমাজ শহুরে ও গ্রামীণ এ দুই ভাগে বিভক্ত। ফলে উভয় ধারার সমাজের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এজন্য সংস্কৃতির অসম অগ্রগতির ফলে সমাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। নিচে এগুলো তুলে ধরা হলো :
১. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অভাব : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান হলেও এদেশের শিল্পের কিছুটা প্রসার ঘটেছে। এদেশের কৃষি ও শিল্পে বিদেশি প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অথচ এ প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর মত এদেশে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ফলে আমরা কৃষি ও শিল্প থেকে প্রযুক্তির আশানুরূপ ফল পাচ্ছি না। অর্থাৎ, দেশে যে হারে প্রযুক্তি আসছে, সে হারে প্রযুক্তিগত জ্ঞান না বাড়ার ফলে সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতা দেখা দিচ্ছে।
২. নাগরিক সুবিধা ও নগর মানসিকতার অভাব : বাংলাদেশে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ যতটুকু বিস্তার লাভ করেছে সে অনুসারে নাগরিক সুবিধা ও নগর মানসিকতা গড়ে উঠেনি। ফলে নগর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ঘনবসতি, ময়লা-আবর্জনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তুত পরিবেশ দূষণ থেকে নগরকে রক্ষা করার তেমন কোনো ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। যার ফলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে ।
৩. কৃষির আধুনিকীকরণ : কৃষির আধুনিকীকরণের ফলে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য অল্পসংখ্যক লোকের
দরকার। অর্থাৎ, অল্প লোকেই অধিক জমি চাষ করতে পারে। কাজেই কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে পরিবারের সদস্যরা
বেকার হয়ে পড়বে। এজন্য কৃষি প্রযুক্তির সাথে চলতে গিয়ে আমাদের দেশে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিজনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
৪. কর্মসংস্থানের অভাব : কৃষি ও শিল্পের পাশাপাশি অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই আজ উন্নত প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। যেমন- কম্পিউটার, ফ্যাক্স, ই-মেইল, ফটোকপি মেশিন, ইলেকট্রিক টাইপ ইত্যাদি। এসব প্রযুক্তির ব্যবহার করার মত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায়, এসব টেকনিক্যাল কাজকর্মের প্রশিক্ষণ না থাকায় সমাজের একটি বিরাট বেকার জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থান করতে পারছে না।
৫. অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি : সংস্কৃতির অসম অগ্রগতির কারণে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ এবং বেকারত্ব, দারিদ্র্য, হতাশা ইত্যাদি দেখা দিচ্ছে। যেমন- বলা যায়, আমাদের দেশে উৎপাদন যন্ত্র বা তার মান যতটুকু যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সাথে সঙ্গতি রেখে জনসংখ্যা না বেড়ে অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে সমাজে নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
৬. শহুরে সংস্কৃতির সাথে গ্রামীণ সংস্কৃতির পার্থক্য : বাংলাদেশের সব অঞ্চলে একই হারে সমান গতিতে অগ্রগতি হচ্ছে না। দেখা যায় কোনো কোনো অঞ্চল বিশেষ কারণে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আবার কোনো কোনো অঞ্চল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে পিছনে পড়ে থাকছে। আমাদের দেশে শহুরে সমাজের সাথে গ্রামীণ সমাজের পার্থক্য
অত্যন্ত প্রকট। যদিও ইদানীংকালে গ্রামীণ সমাজে শহুরে সমাজের ঢেউ লেগেছে, তবে তা অত্যন্ত নগণ্য। শহুরে সংস্কৃতি যেখানে অভিজাত্য ও বিদেশি ভাবধারায় পুষ্ট, সেখানে গ্রামীণ সংস্কৃতি ঐতিহ্যনির্ভর ও সনাতন। ফলে বাংলাদেশের সমাজে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি দেখা দিয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, পৃথিবীর সব সমাজেই সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি রয়েছে। যেহেতু প্রত্যেকটি সমাজ বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত আর প্রত্যেক স্তরের সংস্কৃতিতে রয়েছে ভিন্নতা, এজন্য সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি দেখা যায়। বাংলাদেশের সমাজেও সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি বিদ্যমান। এজন্য এদেশের সমাজের ভারসাম্যও স্বাভাবিক গতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য সংস্কৃতির অসম অগ্রগতি দূর করা বাঞ্ছনীয়।