অথবা, বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্গত সমস্যাসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান ত্রুটিগুলো আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যাবলি বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কী কী ত্রুটি বিদ্যমান রয়েছে? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। একটি জাতির উন্নয়নকে শিক্ষা থেকে পৃথক করে আলোচনা করা যায় না। তাই শিক্ষাব্যবস্থাও হতে হবে যুগোপযোগী এবং মানসম্মত। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যাবলি চিহ্নিত করতে হবে এবং সেগুলোকে সমাধান করতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্গত সমস্যাবলি : বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে, যেগুলো শিক্ষা বিস্তার ও চর্চার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যাবলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. শিক্ষার্থী ঝরে পড়া : বাংলাদেশে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। ২০০৩ সালের এক রিপোর্টে দেখা যায়, দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে ১ কোটি ৭৭ লাখ ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠার আগেই এ সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ৬৬ লাখ ছাত্রছাত্রী। অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সময় এক কোটির বেশি ছাত্রছাত্রী ঝরে
পড়ে। স্কুলের শিক্ষা শেষ করে কলেজে ভর্তি হয় মাত্র ২৩ লাখ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষা স্তরে পৌছার আগেই ১ কোটি ৭৭ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। যা শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।
২. সেসন জট : বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেসন জট একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণত সেসন জটের সৃষ্টি হয়। ফলে একজন শিক্ষার্থীর নির্ধারিত শিক্ষাজীবন শেষ করতে ২ থেকে ৫ বছর বেশি সময় লেগে যায়। ফলে শিক্ষার্থী মূল্যবান সময় হারিয়ে ফেলে। ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি, অনিয়মিত ক্লাস গ্রহণ, ফলাফল প্রদানে বিলম্ব থেকেই সাধারণ সেসন জটের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
৩. পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শিক্ষাদানের অভাব : বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করা হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে বিভিন্ন ধরনের ধর্মঘট, সরকারি হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি দেখা যায় । ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্ম দিবস সংকুচিত হয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই পাঠ্যসূচি শেষ করে দেওয়া হয় । ফলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।
৪. সন্ত্রাস : বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। দেশে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সৃষ্টি হয়। বোমাবাজি, গোলাগুলি, খুন, জখম ইত্যাদি এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা প্রতিনিয়তই পেপার পত্রিকায় দেখতে পায়।
৫. অনিয়িমিত ক্লাস : বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়মিত ক্লাস নেওয়া হয় না। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত একই চিত্র বিদ্যমান । প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং সেন্টার খোলার মধ্য দিয়ে অর্থোপার্জনের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। তারা ঠিকমতো ক্লাস নেয় না এবং ক্লাসে ঠিকমতো পাঠদান করে না। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়।
৬. বই-জার্নালের অভাব : বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পর্যাপ্ত বই-জার্নাল নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের চাহিদামতো নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারে না। এভাবে স্বাভাবিক জ্ঞানচর্চার পথ বাধাগ্রস্ত হয়।
৭. শিক্ষা উপকরণের অভাব: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা উপকরণের অভাব রয়েছে। জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হলে পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের প্রয়োজন যাতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ তুলতে গড়ে তুলতে পারে এবং শিক্ষা লাভের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণের অভাবে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ হারিয়ে ফেলছে।
৮. গবেষণার সীমিত ক্ষেত্র : বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার সীমিত ক্ষেত্রের কারণে প্রকৃত শিক্ষা বিস্তার সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ না পাওয়ায় জ্ঞান আহরণ পরিপূর্ণ হয়ে উঠে না। ফলে শিক্ষার মান হ্রাস পাচ্ছে।
৯. শিক্ষা বাণিজ্য : বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষা ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্যে পরিণত হয়েছে। দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তরিত করেছে। বাংলাদেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে শিক্ষার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি করে চলেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
১০. নকল প্রবণতা : বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা নকল করে পাসের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। ফলে প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার সম্ভব হচ্ছে না। তবে বর্তমান সময়ে নকল করার প্রবণতা অনেকাংশে কমে গেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জ্ঞানের সুষ্ঠু ব্যবহারের শৈলী আয়ত্ত করাই হলো শিক্ষা। বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বিদ্যমান। এর ফলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পরিপূর্ণভাবে মেধা চর্চার সুযোগ না পেলে জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে এবং উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাবলি সর্বাগ্রে দূর করতে হবে।