অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল সহযোগিতাপূর্ণ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর ভূমিকা : বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আগাগোড়া ইতিবাচক সমর্থন প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং একটি নতুন পরাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তারে তৎপর হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম বাঙালি গণহত্যাকে নিন্দা জানায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা : সোভিয়েত ইউনিয়ন অকৃত্রিম আন্তরিকতার সাথে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন প্রদান করেছিল। প্রকৃতপক্ষে মস্কো স্বয়ং যথার্থভাবে আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করে। নিচে এ
বিষয়ে বর্ণনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের আহ্বান : পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রথম নিন্দা জানায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ২ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগর্নি পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানকে উদ্দেশ্য করে এক পত্রে আবেদন করেন “যাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত রক্তক্ষয়ী ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা হয় এবং এর পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়।” এভাবে প্রথম থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
২. নৈতিক সমর্থন প্রদান : সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নৈতিক সমর্থন প্রদান করে। ৬-১০ জুন ১৯৭১ সাল ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং রাশিয়া সফর করে রাশিয়াকে বাংলাদেশ ইস্যুতে আরো সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান।
৩. ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক স্থাপন : মুক্তিযুদ্ধে প্রথম দিকে নীতি ছিল সতর্কতা ও সুবিধাবাদ। ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে আগস্ট পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানকে প্রচুর পরিমাণ আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য দিয়েছে এবং এ সময়েই পাকিস্তানের প্রথম স্টিল কারখানা ও পারমাণবিক শক্তি উন্নয়নসংক্রান্ত সোভিয়েত সাহায্যে চূড়ান্ত করা হয়।
৪. কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে পাকিস্তান। এ ঘটনায় উপমহাদেশে কূটনৈতিক বিপ্লব ঘটে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তার অভাব বোধ থেকে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি। এ চুক্তির পর থেকে বাঙালি বিরোধী যে কোনো আন্তর্জাতিক সমাধানের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নও তৎপর হয়ে উঠে।
৫. চীনপন্থিদের নিবৃত্ত করা : ১৯৭১ সালে ২৭-২৯ সেপ্টম্বর ইন্দিরা গান্ধী মস্কো সফর করে। এরপর থেকে ক্রেমলিনের চিন্তাধারা স্পষ্টতই ভারতপন্থি রূপ পরিগ্রহ করে এবং এর ফলে পাকিস্তান সম্পর্কে সোভিয়েত মনোভাব কঠোর হতে থাকে। অপরদিকে, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হলে আওয়ামী লীগের বিকল্প চীনপন্থি সমাজতান্ত্রিক দল শক্তি অর্জন করতে পারে। যদি চীনপন্থিদের কারণে পরিস্থিতি খাতে যায় সেক্ষেত্রে ভারত সোভিয়েত সম্পর্কে মারাত্মক ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। যার ফলে সোভিয়েত রাশিয়া মুক্তিযুদ্ধে কৌশলগত পরিবর্তন গ্রহণ করে।
৬. ভারতকে অস্ত্র সহায়তা প্রদান : ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের অনুরোধে সাড়া দিয়ে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানে সম্মত হয়। যার ফলে ভারতীয় প্রত
িরক্ষা বাহিনী শক্তিশালী হয়ে উঠে।
৭. জাতিসংঘে বাংলাদেশকে সমর্থন দান : সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধের জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে। জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে একাধিকবার ভেটো প্রদান করে। ভারতীয় বাহিনী ঢাকা দখল করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যে কোনো প্রকারে যুদ্ধবিরতির পদক্ষেপ বানচাল করাই ছিল এ ভেটো দানের উদ্দেশ্য।
৮. নৌবহর প্রেরণ : জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ব্যর্থ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করে বঙ্গোপসাগরে। এর প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ৬ ও ১৩ ডিসেম্বর পারমাণবিক মিসাইলবাহী দুটো ডুবোজাহাজ ভ্লাদিভস্ট থেকে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের এ পদক্ষেপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর প্রত্যাহার করে নেয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে। মস্কোর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রকৃতি যেন মস্কোপন্থি হয় এবং এ লক্ষ্যে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণে ভারতকে সাহায্য করা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে নীতি গ্রহণ করেছিল তা সার্থক ও সফল হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। কাজেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এ বৃহৎ শক্তির ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।