মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ভূমিকা বর্ণনা কর।

অথবা, মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা মূল্যায়ন কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মুক্তিযুদ্ধে প্রচার মাধ্যমগুলোর মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাসহ সমগ্র বাঙালিদের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র উজ্জীবিত করেছিল ! মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের বিভিন্ন নাটক, গান, গণসংগীত, দেশপ্রেম ও সচেতনমূলক প্রচারণা ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় যুক্ত করে। প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কলাকৌশলীরা যে দৃঢ় মনোবল ও সাহস নিয়ে এ বেতারকেন্দ্র পরিচালনা করেছিল যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ও তৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র : ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। এরূপ ভীতিপূর্ণ ও থমথমে অবস্থার প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামে বাঙালি বেতারকমিগণ একটা স্বতন্ত্র প্রচারমাধ্যম গড়ে তোলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাঁরাই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম প্রচার করেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে। ৩০ মার্চ ‘৭১ পাকবাহিনী এ কেন্দ্রে বোমা হামলা করলে ৩০ মার্চ ‘৭১ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র আগরতলা (ভারত) থেকে প্রচারিত হয়। ২৫ মে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ভারতের কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ভূমিকা : নিচে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো :
১. স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার : স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারণা ছিল আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২৫ মার্চ এর এবং আপদকালীন সময়ের জন্য মানসিকভাবে তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২৭ মার্চ এ কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে শোনান। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দেশি ও বিদেশিদের কাছে পৌছে দিতে এ বেতারকেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ।
২. প্রবাসী সরকারের সাথে যোগাযোগ: ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র জারি এবং ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার শপথ নিলে এ সরকার এবং দেশীয় জনগণের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। প্রবাসী সরকার এ বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রচার করত।
৩. মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করা : স্বাধীন বাংলা বেতার মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বক্ষণ উজ্জীবিত করে রাখত। রণাঙ্গনের উজ্জীবনীমূলক গান, কবিতা, বিশ্ব জনমত প্রচার করত যা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করত।
৪. দেশাত্মবোধক সংগীত প্রচার : মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র দেশাত্মবোধক গণসংগীত প্রচার করে জনমত গঠন করে। সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, গাজী মাযহারুল ইসলাম, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রমুখ। তাঁরা দেশাত্মবোধক যে সকল গান লিখতেন তা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র পরিবেশন করত, যা মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল ।
৫. বিশ্ব জনমত সৃষ্টি : স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র বিশ্ব জনমত গঠনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, অত্যাচার, ধ্বংসযজ্ঞ প্রভৃতি খবর প্রচার করত। ফলে বিশ্বব্যাপী মুক্ত িযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারত এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করত। পাকিস্তানি বাহিনীর দৌরাত্ম্য ও দখলদারিত্ব বিশ্ববাসীর কাছে দৃষ্টিগোচর হয় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে।
৬. চরমপত্র পাঠ : স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল চরমপত্র পাঠ। চরমপত্র অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও স্ক্রিপট লেখক ছিলেন এম. আর. আকতার মুকুল। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে, পাকিস্তানি সরকারকে ব্যঙ্গভাবে তিরস্কার করা হতো। এ অনুষ্ঠানটি (মুক্তিযোদ্ধা) বাঙালিদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় যা মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল ।
৭. যুদ্ধজয়ের আশা সঞ্চার : মুক্তি যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও আশা নিয়ে ইতিবাচক খবর প্রকাশ করত। মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনী, অনিয়মিত বাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর সাফল্য প্রতিনিয়ত প্রচার করত। মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র।
৮. ভাষণ ও দিকনির্দেশনা প্রদান : মুজিবনগর সরকারের নীতি নির্দেশনা, সিদ্ধান্ত প্রভৃতি প্রচার হতো স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী প্রমুখের ভাষণ প্রচার করা হতো স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে। যুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রণাঙ্গনের খবর পৌছানো, প্রধান সেনাপতি
এম. এ. জি. ওসমানীর ভাষণ ও দিকনির্দেশনা প্রচারিত হতো। মুক্তিযোদ্ধারা বীরবিক্রমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত।
৯. বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান : স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি উদাত্ত আহ্বান প্রচার করা হয় যে, বাংলাদেশে স্বাধীন সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রত্যেক গণতান্ত্রিক দেশকে এ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন জানানো হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ব্যাপারে সকলকে আশান্বিত করা ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যকে মনে রেখে প্রচারিত হতো অনুষ্ঠান অগ্নিশিখা, রণভেরী, রণাঙ্গনের সংবাদ দর্পণ, বিশ্ব জনমত, জল্লাদের দরবার, চরমপত্র প্রভৃতি। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বজ্রকণ্ঠ প্রচারিত হতো যা মুক্তিযোদ্ধাদের

মনোবল অটুট রাখতে কাজ করেছিল। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ভূমিকাকে ১২নং সেক্টর হিসেবে গণ্য করা হয়।