বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেনের ভূমিকার তাৎপর্য মূল্যায়ন কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অন্যান্য বৃহৎ শক্তির ন্যায় যুক্তরাজ্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাজ্য সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা ছিল নিরপেক্ষ। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম, সংবাদপত্র ও জনগণ পাকিস্তানি গণহত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এবং শরণার্থীদের জন্য সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্য সরকার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান কামনা করে। নিচে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা উল্লেখ করা হলো :
১. লর্ড সভার ভূমিকা : যুক্তরাজ্যের আইনসভার উচ্চকক্ষ লর্ডসভা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশের গণহত্যা, নির্যাতন বন্ধের দাবি জানায় লর্ডসভা। লর্ডসভার কিছু কিছু সদস্য আইনসভার বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাসেল জনস্টোন এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সে দেশের স্বাধীনতা চায়। লর্ডসভার অনেক সদস্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের দাবি জানায়। মূলত লর্ডসভা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিপক্ষে তুমুল আলোচনা বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
২. কমল সভার ভূমিকা : ব্রিটিশ কমন্স সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর বিভিন্ন আলোচনা ও বিতর্ক হয়। ২৯ মার্চ ৭১ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনয়েলথবিষয়ক সচিব স্যার ডগলাস হিউম কমন্সস ভায় এক বিবৃতি প্রদান করেন এবং তিনি পাকিস্তানের ঘটনাবলিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিহিত করেন। এ প্রেক্ষাপটে অন্যান্য এমপিগণ যে সকল প্রশ্ন উত্থাপন ও মন্তব্য পেশ করেন সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়। গণহত্যা বন্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর অনুসারীদের নির্যাতন না করা এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানে চাপ সৃষ্টি করতে কমন্স সভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩. ব্রিটিশ জনমত : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ জনমত গঠন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণহত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন প্রদান করে। ব্রিটিশ জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযোগিতা শুরু করে।
৪. ব্রিটিশ পত্রিকার সমর্থন : ব্রিটিশ পত্রিকাগুলো পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে ছিল সোচ্চার। ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ঢাকায় ছিলেন। ২৫ মার্চ সংঘটিত গণহত্যার বিবরণ ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশ করে । গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরে ব্রিটিশ পত্রিকাগুলো বিশ্ব জনমত গঠন করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগায়।
৫. বিবিসি প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা : বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলোর মধ্যে বিবিসি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন প্রচার করে। ২৬ মার্চ বিবিসির নিয়মিত সংবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার তথ্য প্রকাশ করা হয়। ২৬ মার্চ থেকেই বিবিসি মুক্তিকামী প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। বিবিসির বাংলা বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রচার, সাক্ষাৎ প্রচার, পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মন্তব্য ও বিবৃতি বিশ্ব পত্র-পত্রিকায় প্রচারিত সংবাদ ও ফিচার প্রচার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেনের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকার যদিও ব াংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে তথাপি ব্রিটিশ জনগণ সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসির বাংলা বিভাগের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।