বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার সমস্যা আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার বাধা উল্লেখ কর।
অথবা, বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার অসুবিধা বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় এখানে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। এ সত্ত্বেও এদেশে প্রচলিত ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ সাধন করে এখানে রায়তওয়ারি প্রথার প্রচলন হলেও ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন এখনো ঘটে
বাংলাদেশে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার ত্রুটি : নিম্নে বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার এ ত্রুটিগুলো আলোচনা করা হলো :
১. ভূমিহীন কৃষকের অস্তিত্ব : এদেশে প্রচলিত ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান ত্রুটি হলো ভূমিহীন কৃষকের উপস্থিতি। বাংলাদেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বর্তমানে শতকরা প্রায় ৫২ জন। জমির মালিকানা মুষ্টিমেয় কতকগুলো লোকের হাতে কেন্দ্রীকরণ হওয়ার ফলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি ক্রমান্বয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া নদী ভাঙনের ফলে নদী তীরে বসবাসকারী কৃষকরা ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। ভূমিহীন কৃষকরা জমিতে কৃষি-মজুর হিসেবে কাজ করলেও জমি নিজেদের না হওয়ায় কৃষিকাজে উৎসাহবোধ করে না, ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়ে না।
২. জমির মালিকানায় অসমবণ্টন : জমির মালিকানার বণ্টন সুষম হলে তা কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ধনাত্মক প্রভাব ফেলে। কিন্তু দেখা যায় বাংলাদেশে কৃষিজমির মালিকানা অত্যন্ত অসম। দেশের বেশির ভাগ জমির মালিকানা মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত।
৩. জমিতে মালিকের অনুপস্থিতি : এদেশে ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থায় আর একটি ত্রুটি হলো চাষযোগ্য জমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মালিকরা নিজেরা চাষ করে না। জমির মালিকের মধ্যে অনেকেই শহরে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। বড় বড় জোতদাররাও শহরে বসবাস করেন। তারা বর্গাদারি প্রথায় জমি চাষাবাদ করান। বিভিন্ন জরিপের ভিত্তিতে দেখা যায়, দেশের চাষযোগ্য জমির শতকরা ২০-২৫ ভাগ জমি বর্গাচাষের আওতাধীন ।
৪. বর্গাচাষিদের দুরবস্থা : ফসল ফলানোতে বর্গাচাষিদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য এ যাবৎ তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গৃহীত হয় নি। বর্গাধীন জমিতে বর্গাচাষিদের আইনগত তেমন কোনো অধিকার নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষিকাজের সম্পূর্ণ ব্যয়নির্বাহ করার পরও বর্গাচাষিকে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক মালিককে দিতে হয়। কোনো বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের দরুন ফসলহানি ঘটলে বর্গাচাষিদের দুরবস্থার সীমা থাকে না।
৫. জমি উপবিভাগ ও বিচ্ছিন্নতা : ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ আইনের দরুন এদেশের কৃষিজোতগুলো ক্রমেই হয়। তাছাড়া এরূপ জোতে বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। সমস্যাটি সমাধানের জন্য কার্যকরী আইন উপবিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোতে পরিণত হচ্ছে। খণ্ডিত জমির মাঝখানে আইনের দরুন বিপুল পরিমাণ জমি নষ্ট এখনো প্রণীত হয়।
৬. চাষাবাদের ক্ষেত্রে অদক্ষতা : ত্রুটিপূর্ণ ভূমিস্বত্ব প্রথার কারণে দেশে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির আধিক্য রয়েছে। উপযুক্ত জামানত দিতে না পারায় তারা প্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলো থেকে ঋণ পায় না। দারিদ্র্যের কারণে তারা প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণসমূহ সংগ্রহ করতে পারেন। কৃষি ঋণসহ চাষাবাদের অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহে অপারগ হওয়ায় এরা দক্ষতার সাথে কৃষিকাজ পরিচালনা করতে পারে না।
৭. জমি বন্ধকির ব্যবসায় : ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থায় জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়ার প্রথা প্রচলিত আছে। দরিদ্র কৃষকরা জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়। ফসলপাতি ভালো হলে বন্ধকীকৃত জমি ছাড় করা সম্ভব হয়। এর অন্যথা ঘটলে জমি চিরতরে হাতছাড়া হয় ে যায়। তাছাড়া বন্ধকি জমি ভবিষ্যতে হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় কৃষকরা তাতে তেমন উদ্যোগ নিয়ে চাষাবাদ করে না। ফলে উৎপাদন কম হয়।
৮. জমি মালিকানার ঊর্ধ্বসীমার সুফল থেকে দরিদ্র কৃষকরা বঞ্চিত : সরকারি নিয়মানুযায়ী এদেশে পরিবার প্রতি জমির মালিকানার উচ্চসীমা ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা থাকলেও অনেক পরিবারই বেনামিতে এর চেয়ে অনেক বেশি জমি ভোগদখল করছে। দেশে যৎসামান্য যা খাস জমি রয়েছে তা পুরোপুরি বড় কৃষকদের নিয়ন্ত্রণাধীনে আছে। দেশের হাট বাজার, ঘাট, জলাশয় সবই ধনী কৃষকদের আওতাধীন আছে যা প্রকারান্তরে গ্রামাঞ্চলে ধনবৈষম্য প্রকটতর করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায়, বাংলাদেশে বিদ্যমান ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ। দেশে তাই একটি সুষ্ঠু ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করা একান্ত প্রয়োজন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%80%e0%a6%a3-%e0%a6%b8%e0%a6%ae/