অথবা, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবনে দারিদ্র্যের প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবনে দারিদ্র্যের কুফল সম্পর্কে বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবনে দারিদ্র্যের প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : দারিদ্র্য মানবজাতির জন্য অভিশাপস্বরূপ। এটি একটি দেশের সমুদয় কাঠামোর উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। দারিদ্র্য শুধু একটি সমস্যাই নয়, আরও অনেক সমস্যার জন্মদাতা। আধুনিক
মানবসভ্যতার বিকাশে দারিদ্র্য একটি মারাত্মক অন্তরায়। অনুন্নত ও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের বিশেষ করে বাংলাদেশের অনুন্নয়নের অন্যতম কারণ হলো দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের দিক থেকে শীর্ষ স্থানে অবস্থানকারী তেরোটি দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এ কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু প্রায় ৬৫০০ টাকা বিশ্ব ব্যাংকের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। আর এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে বর্তমান বিশ্বে ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ (Poverty Alleviation) একটি সামাজিক আন্দোলনে (Social Movement) রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবনে দারিদ্র্যের প্রভাব : বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবনে দারিদ্র্যের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। এমন কোনো সেক্টর নেই যেটা দারিদ্র্যের প্রভাবমুক্ত। শতকরা ৮৫ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যা একটা দেশের আর্থসামাজিকের কঠিনতম অবস্থার রূপ স্পষ্ট করে তোলে। নিম্নে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবনে দারিদ্র্যের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. জনসংখ্যা বিস্ফোরণে : জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২-৪৮%। এ হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে আগামী ২০১৫ সালে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১ শত ৫০ কোটি। বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা এ জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের প্রভাব সুস্পষ্ট। জনগণ অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে। আর এ কারণে দারিদ্র্য পরিবারের সদস্য সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি হয়ে থাকে।
২. ভূমিহীনতা বৃদ্ধিতে : বাংলাদেশের শতকরা ১০ ভাগ পরিবারের মোট জমির পরিমাণ ৫০ ভাগের মালিক এবং শতকরা ৬০ ভাগ পরিবার ভূমিহীন ও বিত্তহীন । শতকরা ৭০ ভাগ লোকের খেয়ে বেঁচে থাকার মতো কৃষিযোগ্য ভূমি নেই। মাত্র এ বিশালসংখ্যক ভূমিহীন দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে, যা একমাত্র দারিদ্র্যের কারণে হচ্ছে। ফলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
৩. নিরক্ষরতা বৃদ্ধিতে : বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭০ ভাগ লোক অশিক্ষিত। এ বিশালসংখ্যক নিরক্ষরতার অন্যতম ধারণা হলো দারিদ্র্য । তাছাড়া রোজগারের আশায় তারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে না পাঠিয়ে বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করে। ফলে সমাজে নিরক্ষরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক।
৪. শিল্পের অনগ্রসরতায় : শিল্পের অনগ্রসরতার জন্য দারিদ্রকে দায়ী করা হয়। কারণ শিল্পোন্নয়নে উন্নত প্রযুক্তি ও পর্যাপ্ত মূলধন প্রয়োজন, যা একটি দারিদ্র্য দেশের জন্য ব্যবস্থা করা অতি কঠিন।
৫. বেকারত্ব বৃদ্ধিতে : দারিদ্র্যের কারণে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় খুব কম। আর মাথাপিছু আয় কম হওয়ার কারণে উৎপাদনে বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর বিনিয়োগের স্বল্পতার কারণে উৎপাদন করা যাচ্ছে না, যার জন্য কলকারখানা অচল হয়ে যাচ্ছে। ফলে বেকার সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘আদমজি জুট
মিলের কথা বলা যেতে পারে, যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
৬. বাসস্থানের ক্ষেত্রে : বাসস্থান মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর অন্যতম। সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাসস্থান সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। অথচ বাংলাদেশে দারিদ্র্যের কারণে স্বাস্থ্যকর বাসস্থান নিশ্চিত ক
রা সম্ভব হচ্ছে না। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
৭. পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টিতে : বাংলাদেশের সন্ত্রাস, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রভৃতির মূলে রয়েছে দারিদ্র্য। এ দেশের যৌতুক প্রথা, দাম্পত্য কলহ, নারীনির্যাতন, পারিবারিক ভাঙন প্রভৃতি ঘটনা ঘটছে দারিদ্র্যের কারণে।
৮. অসামাজিক কার্যকলাপ বৃদ্ধিতে : দারিদ্র্যের প্রভাবে অসামাজিক কার্যকলাপের কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠে। দারিদ্র্যের কারণে পতিতাবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, সন্ত্রাস, হত্যা, কিশোর অপরাধ প্রবণতা, দুর্নীতি প্রভৃতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৯. কৃষির অনগ্রসরতায় : ৮৫% লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত থাকা সত্ত্বেও এ দেশের কৃষিতে উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না একমাত্র পুঁজির অভাবে। আর এ কৃষি অনগ্রসরতার প্রধান কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকে দায়ী করা হয়। দারিদ্র্যের কারণে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত সার, বীজ প্রভৃতি নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কৃষিতে অনগ্রসরতা বিরাজ করছে, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত করছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, দারিদ্র্য বাংলাদেশে একটা বড় অভিশাপ আকারে দেখা দিয়েছে। আর দারিদ্র্যের কারণে আনুষঙ্গিক সব সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই বলা হয়, “Poverty is the root cause of all underdevelopment.” এ দারিদ্র্যের প্রভাব বাংলাদেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যার কারণে
উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ তার মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে এবং অসম অর্থ বণ্টনের কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়নে অংশগ্রহণ প্রভৃতি বিষয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং, দারিদ্র্য এ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে, যার বাস্তবতা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি।