অথবা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপরতার কারণসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, দরিদ্র দেশগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়সমূহ কি কি?
উত্তর : বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর অন্যতম। দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মান খুবই নিচু। বিংশ শতাব্দীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এরূপ চরম উন্নতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অনুন্নতির কারণসমূহ উলেখ করা হলো:
১. রাজনৈতিক পরাধীনতা: ভারতবর্ষ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় দু’শ বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ ছিল। ইংরেজরা এদেশের কাঁচামালের উৎস ও নিজেদের শিল্পজাত পণ্যের বাজার হিসেবে ব্যবহার করার লক্ষ্যে আমাদের কুটির শিল্পগুলোকে সমূলে বিনষ্ট করে দেয়। বিদেশি শাসন এদেশের অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশকে রুদ্ধ করে দেয়।
২. পাকিস্তান সরকারের অবহেলা: পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর পাকিস্তানী শাসকবৃন্দ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্তরায়ের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সাহায্যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়িত করেছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তিমিরেই রয়ে গেছে।
৩. অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা: বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষি প্রধান দেশ। কিন্তু আমাদের কৃষি ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত। প্রাচীন চাষ পদ্ধতি, সেচ ব্যবস্থার অভাব, উত্তম বীজ ও সারের অভাব প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ক্ষমতা অত্যন্ত কম। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি খুবই পশ্চাৎপদ।
৪. শিল্পে-অনগ্রসরতা : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনুন্নতির অন্যতম কারণ হলো শিল্পে অনগ্রসরতা। শিল্পায়ন ছাড়া বর্তমানে কোন দেশের পক্ষেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়। মূলধনের স্বল্পতা, কাঁচামালের অভাব, কারিগরি জ্ঞানের অভাব প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে শিল্পায়নের গতি অত্যন্ত মন্থর।
৫. মূলধনের অভাবঃ বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে মাথাপিছু উৎপাদনের পরিমাণ অত্যন্ত কম। ফলে মাথাপিছু আয় কম। ফলে দেশে মূলধন গঠিত হয় না। মূলধনের অভাবে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের
পথে প্রধান অন্তরায়।
৬. প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহারঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনুন্নতির কারণ হলো প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার। বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু মূলধনের অভাব, কারিগরি জ্ঞান ও উদ্যোক্তার অভাবে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হয়নি। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পশ্চাৎপদ।
৭. দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রঃ বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের সকল দিকেই উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। চক্রাকারে ক্রিয়াশীল এই প্রতিবন্ধকতাগুলোকেই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র বলা হয়। উৎপাদন কম বলে আয় কম, আর আয় কম বলে সঞ্চয় কম। আবার সঞ্চয় কম বলে বিনিয়োগ কম। বিনিয়োগ কম বলে উৎপাদন কম। ফলে অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদ রয়েছে।
৮. ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিঃ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ। এখানে জনসংখ্যা অতিদ্রুত গতিতে বাড়ছে। বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা।
৯. শিক্ষার অভাবঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত ও নিরক্ষর। শিক্ষা ক্ষেত্রে এ পশ্চাৎপদতা আমাদের জনশক্তির কর্মদক্ষতা খর্ব করে। এজন্য আমাদের শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষমতা কম। শ্রমিকদের স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
১০. সামাজিক কারণঃ ইংরেজ আমলে ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ নীতি এই অঞ্চলের জনগণকে ধনী ও দরিদ্র এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করে দেয়। সমাজের উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে মুষ্টিমেয় বিত্তশালী ভূ-স্বামী, স্বৈরাচারি সরকারি কর্মচারী ও দুর্নীতি
পরায়ন ব্যবসায়ী আর অন্যদিকে রয়েছে অশিক্ষিত ও দরিদ্র জনসাধারণ। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দিক পশ্চাৎপদ।
১১. দুর্বল অবকাঠামো ঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো খুবই দুর্বল। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, রেলপথ, বিদ্যুৎ, উন্নত শিক্ষার সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি বিষয়গুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একান্ত অপরিহার্য। এদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো দুর্বলের কারণে উন্নয়নের গতি ধীর ও মন্থর।
১২. কারিগরি জ্ঞানের অভাবঃ কারিগরি জ্ঞানের অভাব এদেশের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ। এদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত। দক্ষ ও কুশলী শ্রমিকের অভাবে বাংলাদেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
১৩. দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব: বাংলাদেশে দক্ষ উদ্যোক্তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। পুঁজি বিনিয়োগ করে ঝুঁকি গ্রহণ করার মত উদ্যোক্তার সংখ্যা খুবই কম। দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন উদ্যোক্তার স্বল্পতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
১৪. সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা: উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অন্তরায়ের সৃষ্টি করে। মানুষের রক্ষণশীল আচার-আচরণ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও অদৃষ্টবাদিতা এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত করছে।
১৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে উঠেনি। বস্তুত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
উপসংহার:উপরিউক্ত বিষয়গুলো বাংলাদেশের অনুন্নতির মূল কারণ। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বির করতে হলে এ সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধা অপসারণ করে শ্রমের উৎপাদনশীলতা সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।