পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর বিচার ও বিশ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা কর।

উত্তর৷৷ ভূমিকা : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাংলার মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বন্দি করে। এ সময় তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এরই মধ্যে হানাদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বিচারের নামে প্রহসন শুরু করা হয়। বাঙালির গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাঁয়তারা করা হয়। সংগ্রামী বাঙালিরা এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। তারা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তির দাবির প্রতি বিদেশিদের ব্যাপক সমর্থন পাওয়া সহজ হয়।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আটক করার পর ৩ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানের জেলে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে। ৯ আগস্ট পাকিস্তানের এক সরকারি প্রেসনোটে জানানো হয় যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার অভিযোগে ১১ আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রক্রিয়া : পাকিস্তানের কারাগারে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে বিচারের নামে প্রহসন শুরু করেন। তাঁকে দেশদ্রোহিতার কঠিন অভিযোগে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানোর সবরকম বন্দোবস্ত করলেন তিনি। এদিকে ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রেসনোটে জানান হয় যে, ৭ সেপ্টেম্বর থেকে মি. এ. কে ব্রোহীকে বিবাদীপক্ষের কৌশলী নিয়োগ করা হয়েছে এবং শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিচার আরম্ভ হলে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক আদালতে তার বিচার স্থগিত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু এ আদালতে বলেন যে, আমি কোনো অপরাধ করিনি। তাই বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রশ্নই উঠে না। তাই বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন মুলতুবি রাখে। বঙ্গবন্ধুর বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের প্রত্যক্ষ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না। তাছাড়াও মার্কিন সিনেটর কেনেডি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের অপরাধ হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভকে অভিহিত করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন করেন এবং তাঁর গোপন বিচার আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির চূড়ান্ত বরখেলাপ বলে অভিহিত করেন। যার কারণে ইয়াহিয়া সরকার বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রক্রিয়াকে মুলতুবি করতে বাধ্য হয়।
বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রক্রিয়ায় বিশ্ব প্রতিক্রিয়া : বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই বিশ্ব প্রতিক্রিয়া এক অভূতপূর্ব জাগরণ তোলে। নিচে বঙ্গবন্ধুর বিচারে বিশ্ব প্রতিক্রিয়া আলোচনা করা হলো :
১. মার্কিন সিনেটের এডওয়ার্ড কেনেডির প্রতিক্রিয়া : নয়াদিল্লিতে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে বিচার প্রহসন নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দানের শর্তে বাংলাদেশ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষপাতী।
২. গোপন বিচারের তীব্র নিন্দা : বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচারের তীব্র নিন্দা করে মার্কিন সিনেটর কেনেডি বলেন, “শেখ মুজিব যদি কোনো অপরাধ করে থাকেন তা হচ্ছে এই যে, তিনি একটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। যেভাবে গোপনে তার বিচার হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক আইন ওরীতিনীতির চূড়ান্ত বরখেলাপ ছাড়া কিছুই নয়।”
৪. এডওয়ার্ড কেনেডির কাছে আবেদন ও তৎপরতা : ১৯৭১ সালে আগস্টে আমেরিকান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি দিল্লি অবস্থানকালে মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইনটেলিজেনসিয়াসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির প্রতি প্রভাব বিস্তারের অনুরোধ জানিয়ে তাঁর কাছে
একটি আবেদন উপস্থাপন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি : প্রহসনের নামে অসমাপ্ত বিচারের পর ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের মিয়াওয়ালী কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ঐদিনই তাকে এক বিশেষ বিমানে পাকিস্তান ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়।
উপসংহার : গরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের পূর্ব ও পরে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করেছিল অচিরেই তা ব্যর্থ হয়। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দিক থেকে চাপ প্রয়োগ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।