পর্যবেক্ষণ কাকে বলে? পর্যবেক্ষণের সুবিধা ও অসুবিধা বর্ণনা কর।

অথবা, পর্যবেক্ষণ কী? পর্যবেক্ষণের সবল ও দুর্বল দিকসমূহ বিশ্লেষণ কর।
বক্ষণের সুবিধা ও অসুবিধা বর্ণনা কর।
অথবা, পর্যবেক্ষণ কী? পর্যবেক্ষণের সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর।
অথবা, পর্যবেক্ষণ কাকে বলে?
উত্তর৷ ভূমিকা : মাঠকর্ম অনুশীলনে তথ্য সংগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো পর্যবেক্ষণ। এটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল ভিত্তি। মনোসামাজিক অনুধ্যানে বিশেষ করে সাহায্যার্থীর বক্তব্য ও তার আচরণের মিল খুঁজে বের করার জন্য পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পর্যবেক্ষণের কতকগুলো সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে তথাপি পর্যবেক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি বা কৌশল।
পর্যবেক্ষণ : সাধারণভাবে পর্যবেক্ষণ হলো কোনো বিষয়বস্তু বা ঘটনাকে অবলোকন করা বা দেখা।কিন্তু বৈজ্ঞানিক অর্থে পর্যবেক্ষণ হচ্ছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়বস্তু বা ঘটনাকে সুশৃঙ্খলভাবে অবলোকন করা এবং লিপিবদ্ধ করা।
মোজার এবং কালটন (Moser and kalton) পর্যবেক্ষণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন – “It is a accurate watching and noting of phenomena as they occur in nature with regard to cause and effect or mutual relations” অর্থাৎ, পারস্পরিক সম্পর্ক ও কার্যকরণ সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রকৃতিতে সংঘটিত ঘটনাবলি সঠিকভাবে দর্শন এবং লিপিবদ্ধ করাই হচ্ছে পর্যবেক্ষণ।
কেনেথ ডি. বেইলি ( Kenneth D. Baily) বলেছেন, “The observational method is the primary Technique for collecting data on non-verbal behaviour” অর্থাৎ, অমৌখিক আচরণের প্রাথমিক উপাত্ত সংগ্রহের কৌশলকে পর্যবেক্ষণ বলা হয়।সুতরাং পর্যবেক্ষণ হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি, বস্তু বা ঘটনাকে প্রভাবিত না করে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে অবলোকন করে সেগুলোর সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ করা। বর্তমানে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যেমন : ক্যামেরা, ভিডিও, টেপরেকর্ডার,দূরবীক্ষণ যন্ত্র প্রভৃতি ব্যবহার করেও পর্যবেক্ষণ করা যায়।
পর্যবেক্ষণের সুবিধাসমূহ : পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির সুবিধাসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
১. ব্যক্তির আচরণ উপস্থাপন : পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির অন্যতম সুবিধা হলো এর মাধ্যমে সাহায্যার্থীর আচরণ উপস্থাপন করা যায়। ফলে তথ্য সংগ্রহ করা সহজ হয়। এ প্রসঙ্গে Wilkinson ও Bhandarka বলেন, “পর্যবেক্ষণে গবেষক দল প্রাকৃতিক স্বাভাবিক আচরণ রেকর্ড করতে সক্ষম হন।”
২. ব্যক্তির বাস্তব আচরণ সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ : পর্যবেক্ষণের আর একটি সুবিধা হলো এর মাধ্যমে সাহায্যার্থীর বাস্তব আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন না করেই তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
৩. শিশু ও প্রতিবন্ধীদের পর্যবেক্ষণ : পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে শিশু ও প্রতিবন্ধীদের নিকট থেকে মৌখিক উত্তর না পেয়েও শুধু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এতে করে সমস্যার সমাধান সহজ হয়।
৪. ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রকাশ না করে জানা যায় : সাহায্যার্থী তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রকাশ নাও করতে পারে। এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সম্পর্ক যথাসম্ভব অবগত হওয়া যায়। এর ফলে প্রকৃত সমস্যা জানা সম্ভব হয়।
৫. মাঠপর্যায়ের তথ্যসংগ্রহ : মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সহজ হয়। এক্ষেত্রে গবেষক মাঠপর্যায় থেকে তার প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
৬. সাহায্যার্থীর মানবীয় আচরণ : পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সাহায্যার্থীর মানবীয় আচরণ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।এতে করে সমাজকর্মী বা গবেষকের পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা সহজ হয়।
৭. সামাজিক রীতিনীতি সংক্রান্ত তথ্য : সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানে তার সমাজের রীতিনীতি সম্পর্কে অবগত হতে হয়। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোনো সমাজের রীতিনীতি সংক্রান্ত তথ্য সহজেই জানা যায়। এর ফলে সমস্যার সমাধান
সম্ভব হয়।
৮. তথ্যদাতার ইচ্ছাধীন : তথ্যদাতা নিজের অনেক তথ্য মৌখিকভাবে বলার সময় গোপন করতে পারে।কিন্তু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সংগৃহীত অনেক গোপন তথ্যও বেরিয়ে আসে।
৯. তথ্যের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা : তথ্য সংগ্রহের সময় পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সংগ্রহ করা তথ্যের নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। এর ফলে সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়।
পর্যবেক্ষণের অসুবিধা/ সীমাবদ্ধতা : নিম্নে পর্যবেক্ষণের অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হলো :
১. সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপ করা কঠিন : পর্যবেক্ষণের একটি অসুবিধা হলো এটি গুণগত হলে এর সংখ্যা তাত্ত্বিক পরিমাপ করা কঠিন হয়ে যায়।ফলে সঠিক তথ্য নাও পাওয়া যেতে পারে।
২. ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ : পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির আর একটি সীমাবদ্ধতা হলো এটি ব্যয়বহুল ও দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি করে। এ পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। এর ফলে সমস্যা সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
৩. বারবার পর্যবেক্ষণ করা যায় না : তথ্য সংগ্রহের জন্য বার বার পর্যবেক্ষণ করা যায় না। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণীয় ঘটনা বা অবস্থা বার বার পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না, এর ফলে সমস্যার সমাধান ব্যাহত হয়।
৪. অতীত ও ভবিষ্যৎ ঘটনা পর্যবেক্ষণযোগ্য নয় : কেবল বর্তমানই পর্যবেক্ষণ করা যায়। অতীত, ভবিষ্যৎ ও অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। এটি এর সীমাবদ্ধতা হিসেবে বিবেচিত।
৫. মানুষের মনোভাব সরাসরি জানা যায় না : পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষের মনোভাবকে সরাসরি জানা যায় না।অর্থাৎ ব্যক্তির মানসিক অবস্থা সরাসরি জানার জন্য এটি কোনো কার্যকরী পদ্ধতি নয়। একারণেই দাম্পত্য সম্পর্ক,অপরাধ, যৌন আচরণ প্রভৃতিকে পর্যবেক্ষণ করা যায় না।
৬. ইন্দ্রিয়জাত পর্যবেক্ষণ সবসময় সঠিক হয় না : ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ সবসময় সঠিক হয় না।কেননা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য একেক সময় একেক রকম হয়। ফলে এ ধরনের সমস্যা পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।
৭. বস্তুনিষ্ঠতা নষ্ট হয় : পর্যবেক্ষণের আগ্রহ স্মৃতিশক্তি, পছন্দ-অপছন্দ প্রভৃতির বস্তুনিষ্ঠতা নষ্ট হয়ে থাকে। এর ফলে তথ্য সংগ্রহের এ পদ্ধতির উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় পর্যবেক্ষণ হলো তথ্য সংগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।এর মাধ্যমে তথ্যের সঠিকতা পাওয়া যায়। পর্যবেক্ষণের কিছু অসুবিধা থাকলেও এর সুবিধাই বেশি। তাই সমাজকর্মীকে এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা অত্যাবশ্যক।