পরিবার ও বিবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা ব্যাখ্যা কর।

পরিবার ও বিবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা ব্যাখ্যা কর।
পরিবার ও বিবাহের সাম্প্রতিক ধারা আলোচনা কর।
অথবা, পরিবার ও বিবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা বর্ণনা কর।
অথবা, পরিবার ও বিবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা আলোচনা কর।
অথবা,
উত্তর৷ ভূমিকা : আদিম থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমাদের সকল সমাজ ব্যবস্থাতে পরিবার ও বিবাহ প্রথা ক্রমশ রূপান্তরিত হয়েছে। আধুনিক জীবনব্যবস্থাতে পরিবার ও বিবাহপ্রথার ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। পরিবার ও বিবাহ
অন্যতম সামাজিক দুটি প্রতিষ্ঠান। সামাজিক ক্রমবিকাশের সাথে সাথে এ দুটি প্রতিষ্ঠানও ক্রমশ পরিবর্তনশীল। পরিবার ও বিবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা : সকল প্রকার সমাজেই মানুষ পরিবার ও বিবাহের সাথে
সম্পৃক্ত। আদি হতে আজ পর্যন্ত পরিবার ও বিবাহ প্রত্যয় দুটি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে প্রতিষ্ঠিত রূপ পরিগ্রহ করেছে। বর্তমান সময়ে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুত। অবাধ তথ্য প্রবাহ মানুষের সংস্কৃতি ও মনোভাবে নাড়া দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরিবার এবং বিবাহের ক্ষেত্রেও সূচিত হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। বাংলাদেশের সাজেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। নিম্নে পরিবার ও বিবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা আলোচনা করা হলো :
ক. পরিবারের সাম্প্রতিক প্রবণতা : পরিবারের সাম্প্রতিক প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. পরিবারের আকার পরিবর্তন : প্রাচীনকাল থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিবারগুলো ছিল মূলত যৌথ পরিবার বিশেষ করে গ্রামীণ পরিবারগুলো। কিন্তু বর্তমানে পেশাগত ও অর্থনৈতিক কারণে অনেকে শহরে চলে যাচ্ছে। আবার জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির পক্ষে যৌথ পরিবারের ভরণপোষণ মেটানো সম্ভব
হচ্ছে না। তাছাড়া ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তাভাবনার কারণেও অনেকে যৌথ পরিবার ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পরিবারে মাতা- পিতা মৃত্যুবরণ করলে তাদের ছেলেরা সম্পত্তি ভাগাভাগির কারণে আর যৌথ পরিবারে বসবাস করতে চায় না। ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে তৈরি হচ্ছে একক পরিবার।
২. অর্থনৈতিক কাজে পরিবর্তন : অতীতে গ্রামীণ পরিবার ছিল উৎপাদনের একক। গ্রামীণ পরিবারগুলো ভূমিকেন্দ্রিক হওয়ায় পরিবারস্থ লোকদের ভৌগোলিক সচলতা কম ছিল। কিন্তু জীবিকার তাগিদে মানুষ বর্তমানে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছে। আবার গ্রামে ছোট ছোট শিল্প কারখানা গড়ে উঠায় শিক্ষিত গ্রামীণ যুবকেরা চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে
পড়ছে। ফলে কমে যাচ্ছে কৃষির উপর নির্ভরশীলতা। এখন পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও চাকরি করছে। অথবা কোন আত্ম-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পরিবারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখছে। ফলে পরিবারের অর্থনৈতিক কাঠামোয় দেখা দিচ্ছে পরিবর্তন।
৩. সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন : যৌথ পরিবার ব্যবস্থা থাকার আগে শিশুদের লালন-পালন সামাজিকীকরণে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। কিন্তু বর্তমানে একক পরিবার গড়ে উঠা
পরিবারের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায়ও পরিবর্তন এসেছে। একক পরিবারের বিশেষ করে শহর এলাকায় একর পরিবারের ছেলে-মেয়ের লালন-পালনের ভার এখন কাজের লোকের উপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। বাবা-মা চাকরিজীবী
হওয়ার কারণে সন্তানের দেখাশুনার দায়িত্ব কাজের লোক ছাড়াও বাবা-মা উভয়কে নিতে হচ্ছে যা পূর্বে দেখা যেত না। আবার পরিবারের চাপ কমানোর জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রকম ডে-কেয়ার সেন্টার, বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেয়ার জন্য লোক বা যানবাহন ইত্যাদি।
৪. জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক কাজে পরিবর্তন: মানুষ যে সকল মৌলিক প্রয়োজনে পরিবার গঠন করে তার অন্যতম হচ্ছে জৈবিক প্রয়োজন। এই জৈবিক কাজের মধ্যে রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, সন্তান জন্মদান ও রক্ষণাবেক্ষণ। কিন্তু
বর্তমানে এ জৈবিক কাজে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে, যদিও পরিবারকেই এখনো পর্যন্ত যৌনরীতির মূল কেন্দ্র ধরা হয়। নারী-পুরুষের মধ্যে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক বেড়ে গেছে।
৫. নেতৃত্ব বা কর্তৃত্বের ধরন পরিবর্তন : পরিবারের কর্তৃত্বের ধরন বা Authorityতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। পরিবারের পিতার একক কর্তৃত্ব অনেকটাই খর্ব হয়েছে বিশেষ করে শিক্ষিত পরিবারে। পিতার পাশাপাশি মাতাও এখন
পরিবার পরিচালনায় ভূমিকা রাখছে।
খ. বিবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা : বিবাহের সাম্প্রতিক প্রবণতা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. বিবাহ পদ্ধতিতে পরিবর্তন : আমাদের সমাজে একক বিবাহের প্রচলনই বেশি। সাধারণত অভিভাবকরাই বিবাহের মূল আয়োজক। বিবাহের ক্ষেত্রে এখন ঘটক বা মধ্যস্থতাকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক প্রভাবে শহরের শিক্ষিত সমাজে প্রেম-পরিণয় ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজে এটি এখনো গর্হিত কাজ বলেই
গণ্য করা হয়। এছাড়া বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর মতামত যাচাইয়ের প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার ছেলে- মেয়েদের মধ্যে কোর্ট ম্যারেজের প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।
২. বিবাহরীতির পরিবর্তন : বিবাহের পাত্র-পাত্রী দেখা থেকে শুরু করে বিবাহ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন আচার- অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে। আগের দিনে এসব অনুষ্ঠানকে ঘিরে বিভিন্ন লোকজ উৎসব পালন করা হতো। বর্তমানে
শহুরে বিবাহ অনুষ্ঠানগুলোতেও বর ও কনের পরিবারের মধ্যে সীমিত আনুষ্ঠনিকতাসমূহ পালন করা হয়ে থাকে।
৩. বিবাহের বয়স বৃদ্ধি : বর্তমানে আমাদের সমাজে বাল্যবিবাহের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তবে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। শহুরে সমাজের চেয়ে গ্রামীণ সমাজে অল্প বয়সে বিবাহের সংখ্যাই বেশি। আর্থসামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় আইন
পাসের ফলে সর্বোপরি সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে বিবাহের গড় বয়স ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছেলে-মেয়ের শিক্ষা গ্রহণ এবং নিজেকে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শিক্ষিতদের মধ্যে বিবাহের বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও মেয়েদের চাকরি করার প্রবণতাও বিবাহের বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. বহুস্ত্রী গ্রহণ/ বহু বিবাহ হ্রাস : আমাদের সমাজে মূলত একক বিবাহ প্রচলিত। তবে এ সমাজে কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধি, নারী সচেতনতা ও
আধুনিক মনস্কতা বহু বিবাহের প্রবণতা হ্রাস করেছে।
৫. যৌতুক প্রথা : আগের দিনে কনের বাবা-মাকে ‘কনে পণ’ দিয়ে মেয়েকে বিবাহ দিতে হতো। সেখানে আজ যৌতুক প্রথার অভিশাপ মেয়ের বাবা-মায়ের উপর ক্রমশ চাপ বৃদ্ধি করছে। হিন্দু মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের যৌতুক প্রথা
বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যদিও পরিবার ও বিবাহ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে তথাপি এ পরিবর্তনের মাত্রা তুলনামূলক কম। বিবাহ ও পরিবার যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে কিছুটা পরিবর্তন এলেও এসব
প্রতিষ্ঠানের বিকল্প কোন ব্যবস্থা এখনো তৈরি হয়নি।