জীবনদেবতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনদর্শন আলোচনা কর।

অথবা, জীবনদেবতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনদর্শন ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জীবনদেবতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনদর্শন বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
সমাজের উচ্চাসনে আসীন হয়েও যিনি অবহেলিত,উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভেবেছেন, যাঁর জন্ম বাঙালি জাতির গর্ব, বাংলা সাহিত্যের কর্ণধার, যাঁকে আকাশের সাথে তুলনা করা হয়, যার বিস্তৃতি বিশ্বজোড়া, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যাঁদের কণ্ঠে মানবতার জয়গান শোনা যায়, তাঁদের মধ্যে যিনি নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ,বাংলাদেশ দর্শনের উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর নাম বাংলার যতদিন অস্তিত্ব রবে, যতদিন এ বিশ্ব ধ্বংস না হবে ততদিন রবে সকল মানুষের অন্তরে, তিনিই হলেন বাংলাদেশ দর্শনের অগ্রসৈনিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ দার্শনিকদের মতো চিন্তা করেননি, অথচ তাঁর চিন্তা যুক্তিহীন নয়। তাঁর মধ্যে এমন একটা সূক্ষ্ম বোধশক্তি ছিল, যা তাঁর সকল কল্পনার মধ্যে মনস্বিতা সঞ্চার করেছে। অন্ধ আবেগের বদলে যুক্তিসিদ্ধ কল্পনাকে তিনি তাঁর সমগ্র সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। এ থেকে বলা যায়, তিনি ছিলেন উচ্চমানের একজন দার্শনিক কবি।
জীবনদেবতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনদর্শন : জীবনদেবতা অবস্থান করে মানুষের মধ্যে এবং মানুষের মধ্য থেকেই তিনি পরিচালিত করেন তাঁর জীবনকে। জীবনদেবতা অসীম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু সসীম জগৎকে বাদ উপভোগের আকাঙ্ক্ষা থেকেই বিশ্ব সৃষ্টি, আর এ লীলা প্রকাশের জন্য ঈশ্বরেরও দিয়ে তিনি থাকতে পারেন না। লীলা ভরুকে প্রয়োজন আছে। কবিগুরুর ভাষায়-
“তাই তোমার আনন্দ আমার পর
তুমি তাই এসেছ নিচে
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে “
রবীন্দ্রনাণের চিন্তাক্রম বিকশিত হয়েছে অনাবিল ধর্মীয় প্রত্যয় ও অনুভূতিকে আশ্রয় করে। তাঁর মতে, প্রকৃত ধর্ম আচার সর্বস্ব নয়, মোক্ষ সাধনা কিংবা পরলোকচর্চাও এর মূল লক্ষ্য ও উপজীব্য হতে পারে না। ধর্য মানে দেহ, মন, বুদ্ধি, ইচ্ছার সামগ্রিক কর্ষণ তথা সমগ্র জীবনচর্চার মাধ্যমে সমাজ ও বিশ্বমানবতার কল্যাণসাধন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ধর্মে আমরা যে ঈশ্বরের পূজা করি, যে জীবনদেবতাকে চায়, তিনি নির্গুণ ব্রহ্ম কিংবা জগতের বাইরে অবস্থিত কোনো অতীন্বিয় সতা নন। তাঁকে নিছক জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে জানা যায় না। হৃদয় দিয়ে, ভক্তি, প্রীতি ও কর্ম দিয়ে পেতে হয়। তিনি মানুষেরই সীমাহীন বিস্তৃতি, মানুষের মধ্যে উপস্থিত মহামানব না জীবনদেবতা। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন,
“যখন তুমি আপনি ছিলে একা আপনাকে তো হয় নি তোমার দেখা।
আমি এলেম, ভাঙ্গল তোমার ঘুম
শূন্যে শূন্যে ফুটল আলোর আনন্দ কুসুম।”
জ্ঞান থেকে পাওয়া যায় সত্যপথে চলার নির্দেশ। কিন্তু জ্ঞানের মধ্যে প্রেম নেই। জীবনে কল্যাগের প্রেরণা আসে প্রেম থেকে। তাই জ্ঞানকে সার্থক করে তুলতে হলে প্রেম অপরিহার্য। আর রবীন্দ্রনাথ মানুষের জগৎ সংসারকে দেখেছেন এক নিরবকাশ প্রেমের লীলা হিসেবে। ধর্মপ্রচারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, সংসার একমাত্র বস্তু, যা সকল বৈষম্যের মধ্যে ঐক্য সাধন করে, সকল বিরোধের মধ্যে শান্তি আনয়ন করে, সকল বিচ্ছেদের মধ্যে একমাত্র যাহা মিলনের সেতু তাকেই ধর্ম বলা হয়। আর তা মনুষ্যত্বের এক অংশে অবস্থিত হয়ে অপর অংশের সাথে কলহ করে না। সকল মনুষ্যত্ব তাহার অন্তর্ভুক্ত। আর রবীন্দ্রনাথ এমন এক ধর্ম, এমন এক জীবনদর্শনের পক্ষপাতী, যাতে জ্ঞান, প্রেম ও কর্ম মিলিত হয়েছে। মানব ধর্মের জয়গানে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “কত দুঃখ, কত ক্লেশ, কত যুদ্ধ, কত মৃত্যু নাহি তার শেষ, শূন্যতা বিচ্ছিন্নতা ও মনের বিক্ষিপ্ততা মানুষকে আজ করে ফেলেছে দিশেহারা, ব্যক্তির মনে সৃষ্টি করেছে এক প্রাণঘাতী নৈরাজ্যবোধ। তাই দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্ খলা, অপরাধমন্যতা ও ছন্দপাত, কোথাও যেন আনন্দ নেই, নেই ভবিষ্যৎ, তাই মুক্তির প্রয়োজন। আর এ প্রকৃত মুক্তি আসে জগতের রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ স্পর্শের তথা সমগ্র বিশ্বের সাথে নিজেকে যুক্ত করায় এবং জ্ঞান ও প্রীতির সর্বজনীন মৈত্রীর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেবাকর্মে প্রবৃত্ত হওয়ায়।”
কবির ভাষায়-
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি,
সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লঙিব মুক্তির স্বাদ।”
স্রষ্টা তাঁর আনন্দরূপ সত্তাকে অভিব্যক্ত করেন সমগ্র সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে। মানুষ ও স্রষ্টার আনন্দময়ে অংশগ্রহণ করে তাঁর উত্তাল প্রেম কর্মের মাধ্যমে। তাই সমগ্র মানুষের প্রকৃত চেষ্টায় মুক্তি আসে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, একটি প্রদীপ যেমন রাতের অন্ধকার দূরীভূত করতে পারে না, তেমনি একক ব্যক্তির চেষ্টায় কল্যাণ সাধিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন সম্প মানুষের সমবেত প্রচেষ্টা। এটাই মানুষের পূর্ণাঙ্গতার পরিপূর্ণ রূপ। আর এজন্য রবীন্দ্রনাথ চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন বাংলাদেশ দর্শনে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ দর্শনের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। মনে রাখা দরকার যে, হিংসা, বিদ্বেষ নয়; মায়া, মমতা, প্রেম দিয়েই মানুষ জয় করতে পারে তাঁর সতায় লুকায়িত পাশবিক প্রবৃত্তিসমূহকে, উপলব্ধি করতে পারে সর্বজীবের ঐক্য এবং অর্জন করতে পারে যথার্থ মনুষ্যত্বের মর্যাদা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দর্শনে এ বিষয়টিকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা তাঁকে একজন অনন্য দার্শনিকের মর্যাদা দিয়েছে।