অথবা, গ্রামীণ সালিশে নেতৃত্বের ধরন তুলে ধর।
অথবা, গ্রামীণ সালিশে নেতৃত্বের প্রকরণ মূল্যায়ন কর।
অথবা, গ্রামীণ সালিশের নেতৃত্বের শ্রেণিবিন্যাস বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সালিশ গ্রামের পুরানো প্রথা। সালিশ শব্দের উৎপত্তি ফারসি ভাষা থেকে যার আভিধানিক অর্থ মধ্যস্থতা বা ইংরেজিতে ‘Mediation’. সালিশের ইংরেজি প্রতিশব্দ Arbitration অর্থাৎ, মধ্যস্থতার দ্বারা নিষ্পত্তি। সালিশ গ্রামীণ দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিরোধ, মনোমালিন্য ইত্যাকার যাবতীয় অসহযোগিতা ও বিরুদ্ধবাদিতা মীমাংসা ও নিরসনের প্রধান উপায় । কোনো অভিন্ন ব্যাপারে দুই পক্ষের (ব্যক্তি, পরিবার, বংশ, গোষ্ঠী, প্রতিবেশী ইত্যাদি পর্যায়ের) মধ্যে অমীমাংসেয় অবস্থার সৃষ্টি হলে কিংবা সামাজিক অপরাধ, সংঘাত দেখা দিলে সালিশের মাধ্যমে এর মীমাংসা করা হয়।
গ্রামীণ সালিশে নেতৃত্বের ধরন (Pattern of leadership of rural arbitration) : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপাদানসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। গ্রাম পর্যায়ে সালিশ, সমাজ প্রভৃতির মত অনানুষ্ঠানিক সংগঠন এবং ইউনিয়ন পরিষদ, মসজিদ কমিটি, বাজার কমিটি, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির মত কাঠামোর উল্লিখিত উপাদানসমূহের মধ্যে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা প্রকাশের মুখ্য আনুষ্ঠানিক সংগঠন। উপায়সমূহের মধ্যে গ্রামীণ ক্ষমতা – গ্রামীণ সালিশ অন্যতম। সাধারণত গ্রামের প্রভাবশালী এবং বংশীয় নেতৃবর্গ সালিশ পরিচালনা বা সালিশে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। তাদের নেতৃত্বের ধরন নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. গ্রামের প্রভাবশালীদের নেতৃত্ব (leadership of rural influentials) : সালিশ যারা পরিচালনা করেন তারা গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি, ধনী কৃষক অথবা মহাজন, গ্রামের ‘বাপ-মা’ হিসেবে তারা গ্রামের অন্যান্য মানুষদের বিচার আচার করেন। বিচারে সাধারণত বিবাদির পক্ষে বা বিপক্ষে একটি সুনির্দিষ্ট রায়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। আর সালিশে দীর্ঘমেয়াদি শ্রেণি স্বার্থের কথা মনে রেখে উভয়পক্ষ আপোষরফায় পৌঁছাতে চেষ্টা করে। সালিশ বা বিচার যাই বলা হোক না কেন, সকলের সামনেই আলাপআলোচনার মধ্য দিয়েই তার কার্যক্রম এগিয়ে চলে।
২. বংশীয় নেতৃবর্গ বা অন্যান্যদের নেতৃত্ব : বংশের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে প্রধান বংশীয় নেতৃবর্গ সালিশ করে এটাকে কোনো পক্ষ মেনে না নিলে অন্যান্য বংশের নেতা, ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধি, সমাজ নেতা বা অন্য এক বা একাধিক সালিশি হিসেবে যারা থাকেন তাদেরকে গ্রামের পতি, তাদের প্রধান, প্রামাণিক, মণ্ডল, মাতব্বর ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তারা গ্রামীণ ধনী অভিজন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সালিশে গ্রামীণ ধনী অভিজন শ্রেণিই নেতৃত্ব দিতেন দাতা গ্রহীতা সম্পর্ক এবং জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের সাথে সংযুক্তি ও সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগের কারণে সুদীর্ঘকাল যাবৎ সালিশের মাধ্যমে ধনী অভিজন শ্রেণি তাদের শ্রেণি স্বার্থ, দলাদলি, রাজনীতিতে অনুসারীদের সুবিধা প্রদান, প্রতিপক্ষকে অবদমিত রাখার প্রয়াস চালিয়েছে। এরিক জিজানসেন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন ঝগড়াঝাটি নিষ্পত্তিতে যে মাতব্বর বেশি ডাক পাবেন, মাতব্বর হিসেবে তার অবস্থান.আরও বেশি শক্তিশালী হবে। Kristen Westerguard এর মতে, কেবলমাত্র ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই সালিশের
সদস্য হয়। সালিশের মাধ্যমে সমাজে তারা প্রভাব খাটাতো এবং প্রভাব বৃদ্ধির জন্য ধনী কৃষকরা নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত ।
৩. স্থানীয় সরকারের নেতৃত্ব (Leadership of local government) : স্থানীয় সরকারের কাছে স্থানীয় দরকারে মানুষ যাবেই। কথায় কথায় মানুষ রাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগে কাছে যায় না। রাষ্ট্রীয় বিচার বিভাগে গরিবের প্রবেশের সুযোগ খুবই কম। শুধু গরিব কেন, নিম্নবিত্তের অধিকাংশই মামলা এড়াতে চায়। সেজন্যই
তারা ইউনিয়ন পরিষদ নেতাদের মাধ্যমে কখনও বা এলাকার অন্য প্রভাবশালীদের মাধ্যমে সালিশি প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। ‘সালিশি ব্যবসায়’ এখন গ্রামাঞ্চলে অনেক টাটিটম্বি মাতব্বরদের। সাধারণ মানুষ এ ব্যবসায়ের সাথে বসবাস করে সংকট মুক্তির পথ খোঁজে। অতএব, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সদস্যরা পক্ষের লোক হলেই সুবিধা। (১৮ এপ্রিল, ২০০৩, দৈনিক যুগান্তর)
৪. সালিশে নেতৃত্বদানকারীদের শিক্ষা ও পেশা একটি জরিপ (Education and occupation is a survey of leaders in arbitration) : আতিউর রহমান ৯৩ জন ক্ষমতাবান, যারা সালিশে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন তাদের উপর পরিচালিত এক জরিপে দেখিয়েছেন যে, তাদের ৩০% এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা (এস. এস. সি ও তার উপর) রয়েছে। তবে বয়সে যারা নবীন (৩০-৪০) তাদের প্রায় সকলেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা রয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের ২৬.৮৮% স্বাক্ষর করতে পারেন এবং ৩২.২% নিরক্ষর, ভূমিমালিকানার দিক থেকে ৫৮.৩৮% এর জমির পরিমাণ ৭.৫একরের বেশি, ২.৬১-৭.৫০ একর জমি রয়েছে ৪৩.০১ এর এবং ২.৬০ একর পর্যন্ত জমি রয়েছে ৮.৬০% ক্ষমতাবানের। পেশার দিক থেকে ৪৯.১৪% এর পেশা কৃষি, ২৯.৮৮% ব্যবসায়, ৩.২৩% ঠিকাদারি এবং ১০.৭৫% অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত। ক্ষমতাবানদের শতকরা ৭৫ জনের বাবাও মাতব্বর ছিলেন। পেশা চিহ্নিতকরণে আতিউর রহমান তাঁর এ গবেষণায় সরলীকরণ করেছেন। কেননা, গ্রামে সাধারণ ও ধনী অভিজন শ্রেণি উভয়েরই একাধিক পেশা থাকে, যার মধ্যে কোনটা মুখ্য, কোনটা গৌণ। এছাড়া ধনী অভিজন শ্রেণি জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দল ও সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে দরিদ্রদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে নিজেদের ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি করে। তরপরও এ জরিপের ফলাফল থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, সালিশে ইতোপূর্বে গ্রামীণ দরিদ্রদের ভূমিকা ছিল হয় বাদী, নয় বিবাদী কিংবা দর্শকের, কখনও তারা সালিশে নেতৃত্ব দিতে পারে নি।
সালিশের রায় : সালিশের রায়ের প্রকৃতি সর্বাংশে নির্ভর করে এর নেতৃত্বের প্রকৃতির উপর। সালিশে নেতৃত্বদানকারী অভিজন শ্রেণি তাদের শ্রেণি স্বার্থের দিকটি বিশেষভাবে বিবেচনা করে থাকেন। কিন্তু দরিদ্ররা অসংগঠিত হওয়ার কারণে তাদের বিপক্ষে রায় গেলে তারা কোন প্রতিবাদ করতে পারে না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকে প্রতিবাদ করলেও তাদের প্রচেষ্টা বা আন্দোলন স্থায়ী হয় না।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি যে, গ্রাম্য সালিশের নেতৃত্বের ধরন গ্রামের প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবানরাই সালিশে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। সালিশে অনেক সময় বাইরে গ্রামের মাতব্বরদের ডাকতে হয়। বলা বাহুল্য, মাতব্বররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোপনে বাদী বিবাদী উভয় পক্ষকে মন্ত্রণা দিয়ে বিরোধ বজায় রেখে কিংবা বাড়িয়ে দিয়ে ঘটনা জটিল করে নিজেদের ক্ষমতা চর্চা করে থাকে। সালিশে বিবাদী ক্ষমতাবান হলে ক্ষমতাবানরা তার পক্ষে রায় দিয়ে থাকে, তাদের ভাষায়, ‘বলীরা বলীদের পক্ষ নেয়’। ক্ষমতাবান যারা সবসময় সালিশ বিচার করে থাকে, তারা অর্থ আত্মীয়তা ও দাতা গ্রহীতা সম্পর্কের কারণে নিরপেক্ষ রায় দেয় না। এতদসত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলে মাতব্বররা বংশ পরম্পরায় সালিশ করে আসছে। অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে সালিশের নামে প্রহসন। বাদী বিবাদী উভয়পক্ষকেই মেনে নিতে হচ্ছে মাতব্বর ও সর্দারদের একচ্ছত্র আধিপত্য বা বিতর্কিত ও নেতিবাচক নেতৃত্বের ধরন।