অথবা, গ্রামীণ পরিবারের কী কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ পরিবারের প্রকৃতি আলোচনা কর ।
অথবা, গ্রামীণ পরিবারের বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজবিজ্ঞানীরা সকল মানবগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবারকেই মুখ্য গোষ্ঠী বলে বিবেচনা করে থাকেন। কারণ সমাজ জীবনে ছোট বড় নানারকম সামাজিক সংগঠনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পরিবারের তুলনায় কোনটিরও সামাজিক গুরুত্ব বেশি নয়। পরিবারের প্রভাব সমগ্র সমাজ জীবনের উপর পতিত হয় এবং পারিবারিক পরিবর্তন সমগ্র সমাজ জীবনের উপর প্রতিক্রিয়া ঘটায়।
গ্রামীণ পরিবারের বৈশিষ্ট্যসমূহ : গ্রামীণ পরিবার বিভিন্নভাবে মানুষের সমগ্র জীবনকে প্রভাবিত করে। সেজন্য মুখ্যগোষ্ঠী হিসেবে পরিবার গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানে স্বীকৃত অপরাপর গোষ্ঠী থেকে স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে। পরিবারের বিভিন্ন সংজ্ঞা পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে এসব উল্লেখ করা হলো :
১. সর্বজনীনতা (Universality) : গ্রামীণ সমাজ জীবনের যত রকম রূপ আছে, পরিবার হলো সংঘবদ্ধ জীবনের সবচেয়ে বিশ্বজনীন রূপ। গ্রামীণ সমাজ তথা সকল সমাজেই এবং সমাজ বিকাশের প্রত্যেক স্তরেই পরিবারের অস্তিত্ব রয়েছে। অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ বলেছেন, “It is the most nearly universal of all social forms. It is found in all societies, at all stages of social development.”
২.অনুভূতিসূচক ভিত্তি (Emotional Basis) : বংশধারা সংরক্ষণের যে জৈবিক প্রয়োজন বা উদ্দেশ্য তার উপর নির্ভর করে পরিবারের ভিত্তি। গ্রামীণ পরিবার মানুষের স্নেহ, ভালোবাসা, সন্তানসন্ততি জন্মদানের আগ্রহের উপর নির্ভরশীল। গ্রামীণ পরিবার এমন একটি সুসংবদ্ধ গোষ্ঠী যার মাধ্যমে মানুষের উক্ত অনুভূতিগুলো প্রকাশ পায়। বলা যায়, “It is based on a complex of the most profound impulses of our organic nature, those of mating, procreation, material devotion and parental care.”
৩. গঠনমূলক প্রভাব (Formative Influence) : গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবার তার সদস্যদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এটি পরিবারভুক্ত ব্যক্তিবর্গের চরিত্র গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ফ্রয়েড ও অন্যান্য মনোবিজ্ঞানী তাঁদের গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে, একটি শিশু যখন যৌবনে পদার্পণ করে, তখন যে ধরনের মানসিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটায় সেসব পরিবার থেকেই আয়ত্ত করে। আর যারা শৈশবে পিতামাতার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় স্নেহ ভালোবাসা পায় না, তারা কখনও চরিত্রবান হয়ে গড়ে উঠতে পারে না।
৪. সীমিত আকৃতি (Limited Size) : গ্রামের পরিবারগুলো হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী জীবন। কারণ গ্রামীণ সমাজ জীবনের অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় পরিবার সবচেয়ে ক্ষুদ্র। কতকগুলো জৈবিক প্রয়োজনের দ্বারা পরিবারের সংগঠন নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট হয়। এক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন, গ্রামের পরিবারগুলো ঐতিহ্যগতভাবে যৌথ পরিবার। তবে আর্থিক দুরবস্থা, পেশাগত পরিবর্তন, সম্পত্তি সিলিং নীতি, মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত ইত্যাদি কারণে যৌথ পরিবারে দ্রুত ভাঙন দেখা দিয়েছে।
৫. কেন্দ্রীয় অবস্থান (Nuclear position) : অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের মূল অংশ (Nucleus) হিসেবে পরিবারের কথা বলা হয়। গ্রামীণ পরিবার যেমন সহজসরল সমাজব্যবস্থার মূল অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়, তেমনি সমাজসভ্যতার উচ্চতর জটিল পর্যায়েও সামাজিক সংগঠনের মূল কেন্দ্র হলো পরিবার। বিবাহ, মাতাপিতার দায়দায়িত্ব
এবং রক্তের বন্ধন গ্রামের পরিবারগুলোকে উক্ত সমাজের মুখ্য প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গে পরিণত করেছে।
৬. সদস্যদের দায়িত্ববোধ (Responsibility of the Members) : গ্রামীণ পরিবারে শিশুরা সামাজিক দায়দায়িত্বের অর্থ অনুধাবন করে এবং সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজ এ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, “In times of crisis men may work and fight and die for their country, but they toil for their families all their lives.” (Society, P. 241)।
৭. সামাজিক নিয়মকানুন (Social Regulation) : গ্রামের পরিবারগুলো ক
তক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সামাজিক প্রথা ও আইনকানুনের দ্বারা সংরক্ষিত থাকে। পরিবারের কোনো সদস্যের পক্ষে সহজে এসব অমান্য করা সম্ভব নয়। সমাজ কর্তৃক নিন্দিত বা সমাজবিরোধী আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বও প্রাথমিকভাবে পরিবারই গ্রহণ করে। গ্রামীণ পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিরা শিশু-কিশোরদের ব্যবহার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন যা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অবদান। অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ মন্তব্য করেছেন, “It is peculiarly guarded both by social taboos and by legal regulations which rigidly prescribe its form.”
৮. স্থায়ী এবং অস্থায়ী (Permanent & Temporary) : গ্রামীণ সমাজে পারিবারিক সংগঠন যদিও স্থায়ী এবং সর্বজনীন, তবু সংঘ হিসেবে পরিবার হলো সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল। যে পুরুষ ও নারীকে কেন্দ্র করে একটি পরিবারের শুরু, তাদের মৃত্যুর পর তাদের সন্তানদের কেন্দ্র করে নতুন পরিবারের জন্ম হয়। কাজেই আমরা যখন কোনো গ্রামীণ পরিবারের কথা উল্লেখ করি, তখন আমাদের বুঝতে হবে যে, একাধিক পরিবারের বংশপরম্পরায় তার স্থায়িত্ব বজায় রয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রামীণ সমাজের সকল গোষ্ঠীর মধ্যে পরিবারই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সীমিত আকৃতিসম্পন্ন এবং এটি অন্য সকল গোষ্ঠীর চেয়ে স্বতন্ত্র ! এটা ক্ষুদ্রতম আত্মীয়বর্গের একটি গোষ্ঠী। আমাদের গ্রামীণ সমাজের পরিবারগুলো আজও একাধারে উৎপাদন ও ভোগের একক। তাই গ্রামীণ পরিবারের কাজ লোপ পেয়ে যায়নি। অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা, বৃদ্ধ বয়সের নিরাপত্তা, রোগসেবা, শোকে সান্ত্বনা প্রভৃতি সামাজিক কার্যাবলি গ্রামের মানুষেরা পরিবারের মাধ্যমেই সম্পন্ন করে থাকে। গ্রামবাসী তাদের সম্পত্তির অধিকার পরিবারের মধ্য দিয়েই লাভ করে। আর এসবই সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ পরিবারের বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত হয়। গ্রামীণ পরিবারের বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতির পরিবর্তন হওয়া বিশেষভাবে লক্ষণীয়।