একটি আদর্শ প্যারোল পদ্ধতির নীতি এবং কার্যপ্রণালি ব্যাখ্যা কর।

অথবা, একটি আদর্শ প্যারোল পদ্ধতির নীতিমালা বর্ণনা কর।
অথবা, একটি আদর্শ প্যারোল পদ্ধতির কার্যনীতি বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পর থেকে কারাগার ব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন সংশোধনমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। আর সে কারণেই অপরাধীর চারিত্রিক সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আজ সর্বজনস্বীকৃত। আর তাই চারিত্রিক সংশোধনের ক্ষেত্রে “পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা কর” এ নীতি গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে অপরাধ কর্মের চেয়ে অপরাধী যে কারণে অপরাধে লিপ্ত হয় সে কারণের উপরই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। আধুনিক বিশ্বে অপরাধীর সংশোধনমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। প্যারোল এ পদ্ধতিগুলোর মাঝে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি । একটি আদর্শ প্যারোল পদ্ধতির নীতি ও কার্যপ্রণালী : প্যারোল হচ্ছে অপরাধীর সংশোধন এবং পুনর্বাসনমূলক এমন এক ব্যবস্থার নাম যেখানে অপরাধী সাময়িকভাবে বিশেষ শর্তাধীনে সমাজ জীবনে প্রত্যাবর্তন করে, তবে প্যারোলে যাওয়ার পূর্বে তাকে প্রদেয় নির্ধারিত শাস্তি সীমার কিছুকাল কারাগারে কাটিয়ে আসতে হয়। আর এ প্যারোল ব্যবস্থার সফলতার জন্য কিছু নীতি এবং কার্যপদ্ধতি অনুকরণ করা হয়। নিম্নে প্যারোল ব্যবস্থার নীতি ও কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. কোন কোন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে প্যারোল ব্যবস্থাধীনে রাখা হবে তা সতর্কতার সাথে নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, মনোভাব এবং তার সামাজিক ও পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য অনুসন্ধান করে তবেই তার প্যারোল প্রদানের বন্দোবস্ত করতে হবে।
২. কারাবন্দিদের সম্পর্কে সংগৃহীত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যখন বিশ্বাস জন্মাবে যে, অপরাধীকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি প্রদান করলে তার চারিত্রিক আচরণের উন্নতি ঘটবে কমাত্র তখনই কেবল
তাকে প্যারোলে প্রেরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
৩. কারাবন্দিদের প্যারোলে পাঠানোর আগে ভেবে দেখা দরকার যে, শর্তসাপেক্ষে কারাবন্দিদের মুক্তি প্রদান করলে তাদের সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে কি না। কারণ অপরাধী সম্পর্কে তার নিজস্ব সমাজ একটি বিবেচনা প্রসূত শাস্তি প্রত্যাশা করে। কোন বিশেষ কারাবন্দিকে প্যারোলে প্রেরণ করলে সমাজ যদি মনে করে যে, অপরাধীকে বরং শাস্তি ছাড়াই মুক্তি প্রদান করা হচ্ছে তাহলে প্যারোল ব্যবস্থা প্রত্যাশিতভাবে কার্যকর করা সম্ভব হবে না।
৪. প্যারোলে প্রেরিত অপরাধীর চারপাশের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি যাতে তার চারিত্রিক উন্নয়নের অনুকূল বলে বিবেচিত হয়, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে
৫. প্যারোলের অধীনে অপরাধীর কর্মসংস্থান যাতে সম্ভবপর হয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত প্রয়াস থাকা দরকার। বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকলে প্যারোলাধীন অপরাধী দ্রুত চারিত্রিক উন্নয়ন ঘটিয়ে সমাজে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করে।

৬. অপরাধী প্যারোলে থাকাকালীন সময়ে তার সাথে নিয়মিত প্যারোল কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ রক্ষা করবে। এজন্য তাকে প্রয়োজনীয় উপদেশ নির্দেশ প্রদান করে সমাজের সাথে খাপখাইয়ে চলার বন্দোবস্ত করা দরকার।
৭. প্যারোলে প্রেরিত অপরাধীকে সমাজে পুনর্বাসিত করার চেষ্টায় প্যারোল কর্মকর্তার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে। এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্যারোল কর্মকর্তা আরো দক্ষতার সাথে তার দায়িত্ব পালন করার সুযোগ লাভ করতে পারেন।
৮. অনেক সময় প্যারোলে প্রেরিত অপরাধী যদি জানতে পারে যে, তার শাস্তি সীমা সমাপ্তির পথে তাহলে সে তার চারিত্রিক উন্নতি ঘটাতে ব্যর্থ হয়। এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে প্যারোল কার্যবন্দির মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। প্রয়োজনবোধে কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পরও অপরাধীর বিশেষ প্যারোল ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
৯. প্যারোল কর্মকর্তাবৃন্দের কাজের সমন্বয় সাধনের জন্য প্যারোল বোর্ড অথবা কমিশন থাকবে। এ প্যারোল বোর্ড কিংবা কমিশন গঠিত হবে যারা বুদ্ধিজীবী এবং সমাজে মর্যাদাসম্পন্ন এবং এ ধরনের কাজে অভিজ্ঞ এবং উৎসাহী। কোন রাজনৈতিক অভিপ্রায়ে এসব ব্যক্তিকে প্যারোল বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত করা যাবে না।
১০. প্যারোল কর্মকর্তার সংখ্যা পর্যাপ্ত পরিমাণ হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় তত্ত্বাবধান কাজে তাকে উপযুক্ত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। মূলত সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজকল্যাণ এবং অপরাধবিজ্ঞানে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ প্যারোল কর্মকর্তা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। তাছাড়া প্যারোল কর্মকর্তার কিছু বিশেষ গুণাবলিও থাকতে হবে। যেমন-
ক. সৎ এবং উদ্দেশ্যপ্রবণ,
খ. ধীর প্রকৃতির বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন,
গ. ধৈর্যশীল,
ঘ. রসিক সর্বোপরি মানব চরিত্র সম্পর্কে আশাবাদী মনের অধিকারী হবেন।
১১. প্যারোল বোর্ড কিংবা প্যারোল কমিশন সকল কার্যক্রম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে যাতে বাইরের কোন হস্তক্ষেপ প্যারোলের মূল উদ্দেশ্যকে কোন অবস্থায়ই ব্যাহত করতে না পারে।
১২. প্যারোলে প্রেরিত হওয়ার আগে অপরাধীকে প্যারোল চুক্তিতে স্বাক্ষর প্রদান করতে হয়। চুক্তিতে অন্যান্য শর্তের
মাঝে অন্যতম শর্ত হলো অপরাধী যদি প্যারোল ব্যবস্থার কোন নিয়ম লঙ্ঘন করে, তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ কারাগারে ফেরত পাঠানো হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, আধুনিক যুগে প্যারোল ব্যবস্থার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যবস্থায় অপরাধীকে শাস্তিও ভোগ করতে হয়, আবার সংশোধনেরও সুযোগ লাভ করে। মূলত প্যারোল ব্যবস্থায় শাস্তি এবং সংশোধনের মাঝে সমন্বয় সাধন করা হয়। এ কারণেই এ ব্যবস্থা সমাজ এবং অপরাধী উভয়ের জন্যই কল্যাণকর।