আবুল হোসেনের দর্শন ব্যাখ্যা কর। তৎকালীন বাঙালি মুসলিম সমাজে এর প্রভাব ছিল কতটুকু?

অথবা, বাংলাদেশ দর্শনে আবুল হোসেনের অবদান কতটুকু? তৎকালীন বাঙালি মুসলিম
সমাজ তাঁর অবদানকে কীভাবে গ্রহণ করেছিল?
উত্তর৷৷ ভূমিকা : খ্রিস্টীয় উনিশ এবং বিশ শতক বাঙালি জাতির জন্য এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এ সময়েই বাঙালি জাতির প্রথিতযশা দার্শনিক মহলের আবির্ভাব। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হোসেন প্রমুখ দার্শনিক তাঁদের নিজস্ব প্রজ্ঞার মাধ্যমে তৎকালীন পতনোন্মুখ বাঙালি জাতির মুক্তির পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এসব দার্শনিক তৎকালীন সমাজে প্রচলিত সবধরনের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতেন। আর তাঁদের এ স্বাধীন চিন্তার ফলশ্রুতিই আজ এই বাঙালি জাতির যত অর্জন।
বাংলাদেশ দর্শনে আবুল হোসেনের অবদান : বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলিম সমাজের আত্মোন্নয়নে যে দার্শনিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার অন্যতম পুরোধা ছিলেন আবুল হোসেন। বাঙালি মুসলিম সমাজ
ছিল তখন অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ একটি মজা পুকুরের ন্যায়, যেখানে উৎপাদন করলে অনেক কিছুই করা সম্ভব অথচ জঙ্গলে তা আটকে আছে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে আবুল হোসেনসহ তৎকালীন কিছু প্রগতিশীল দার্শনিক বাঙালি মুসলমানদের উন্নতির জন্য কাজ করার শপথ গ্রহণ করলেন। এ উদ্দেশ্য অর্জনের অভিপ্রায়ে আবুল হোসেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। এই সাহিত্য সমাজের মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালীন
বাঙালি মুসলিম সমাজের মন থেকে সবরকম অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূর করে সেখানে যুক্তিবিচারের অবস্থান পাকাপোক্ত করা। এই সংগঠনের একটি মুখপত্র ছিল যার মাধ্যমে সাহিত্য সমাজের চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটত। এই মুখপত্র যার নাম ‘শিখা’, তার একজন বিশিষ্ট লেখক ছিলেন দার্শনিক আবুল হোসেন। নিম্নে তাঁর দার্শনিক অবদান ব্যাখ্যা করা হলো :
১. যুক্তিবাদিতা : প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী লেখক দার্শনিক আবুল হোসেন সবরকম কুসংস্কার থেকে মনকে মুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে চিন্তা করে বাঙালি মুসলমানদের উন্নতির দিক নির্দেশ করেন। তিনি অন্ধভাবে শাস্ত্রানুগত্য হয়ে কোন কাজ করার বিরোধী ছিলেন। তিনি যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সত্যকে গ্রহণ করতে বলেন। তিনি ধর্মীয়, সামাজিক প্রতিটি বিষয়
বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রহণ করার পক্ষে মত দেন। বিচারহীন চিন্তাচেতনা কখনও কোন সুফল বয়ে আনতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। যুক্তিপূর্ণভাবে চিন্তা করতে গেলে প্রথমে দরকার হয় বুদ্ধির মুক্তি। তাই আবুল হোসেনসহ অন্যান্য প্রথিতযশা তৎকালীন প্রগতিশীল কিছু দার্শনিক ‘শিখা’ নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন, যার প্রতিটি
সংখ্যার শিরোনামের নিচে লেখা থাকত জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। তাঁরা যথাসম্ভব জ্ঞান অর্জনের পক্ষে যুক্তি দেন। কারণ যথার্থ জ্ঞান মানুষকে যুক্তিবাদী হতে শেখায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের (বাঙালি মুসলিম সমাজের) যুগ যুগান্তরের আড়ষ্ট বুদ্ধিকে মুক্ত করে জ্ঞানের অদম্য পিপাসা জাগিয়ে দেওয়া
উচিত। কিন্তু তাতো রাতারাতি হওয়া অসম্ভব। এসব দার্শনিকদের প্রধান উদ্দেশ্য মুক্ত চিন্তার চর্চা এবং জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা ও রুচি সৃষ্টি এবং তদুদ্দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নতুন, পুরাতন সর্বপ্রকার চিন্তা ও জ্ঞানের সমন্বয় ও সংযোজন সাধন। আবুল হোসেন একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইসলাম ধর্মের প্রচলিত সকল নীতিকে গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি প্রচলিত নিয়মকানুনের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এ কারণেই তিনি বলেছেন, “অন্যান্য ধর্মের ন্যায় ইসলামও কতকগুলো আদেশ ও নিষেধের সমষ্টিমাত্র। ইসলাম মানুষের৷ জন্য, মানুষ ইসলামের জন্য নয়। কালের পরিবর্তনে অবস্থার বিপর্যয়ে ধর্মশাস্ত্রের কথা মানুষ পুরোপুরি পালন করতে পারে না এবং যেহেতু সংসারের উন্নতির জন্যই মূলত ধর্ম বিধানের সৃষ্টি, সেহেতু ধর্মগুরুর আদেশের নিগ্রহ হতে মুক্তি না পেলে মুসলমানতো মানুষ হবেই না, বরং ইসলামও কেবল Dead Letter হয়েই থাকবে।”
এভাবে আবুল হোসেন ইসলামের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং স্বদেশ স্বজাতির উদ্দেশে ইসলামের যুক্তি স্বরূপ উপস্থাপন করেন।
২. উদারতাবাদ : আবুল হোসেন একজন উদারতাবাদী দার্শনিক ছিলেন। কোন ধর্ম, বর্ণ বা জাতির কোন বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি কোনকিছুর ব্যাখ্যা করা বা দেখা পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন এদেশের অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য৷ ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি বিশ্বের সবাইকে একই স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে দেখতেন। তাই যার কাছে যা ভালো আছে তা আমাদের গ্রহণ করা উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন, তা না হলে জাতি হিসেবে আমরা অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ব। এ কারণে তিনি ব্রিটিশদের উদার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ইংরেজ বণিকদের সাথে ইউরোপের জ্ঞানদীপ্ত মন যখন এলো আসলো এবং আমাদের আড়ষ্ট মনকে আঘাত করল তখন হিন্দু ভাইয়েরা তা সাদরে গ্রহণ করল, কিন্তু কূপমণ্ডূকতার কারণে মুসলিম সমাজ সেটাকে গ্রহণ করল
না, যে কারণে মুসলিম সমাজ আজও অন্যদের তুলনায় পশ্চাৎপদ। এভাবে আবুল হোসেন তাঁর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যা কিছু ভালো তাকে গ্রহণ করেন এবং যা কিছু মন্দ তাকে বর্জন করেছেন।
৩. মানবতাবাদ : বাংলাদেশ দর্শনের অন্যান্য দার্শনিকের মতো আবুল হোসেনও তাঁর দার্শনিক চিন্তায় মানবতাবাদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নাম হলেও এটি শুধু মুসলমানদের সংগঠন নয়, এখানে সকল ধর্মের প্রগতিশীল ব্যক্তির স্থান রয়েছে। তিনি বলেছেন, মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্দেশ্য হলো বাঙালি
মুসলমানদের উন্নত করা। কারণ তিনি চেয়েছিলেন সমস্ত বাঙালি সমাজের উন্নতি। তিনি লক্ষ্য করলেন বাঙালি হিন্দুরা শিক্ষিত, কিন্তু মুসলমানরা অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ। তাই সমগ্র বাঙালি জাতির উন্নয়নে মুসলমানদেরও উন্নত করা প্রয়োজন । তিনি বলেছেন, মুসলমানদের উন্নয়নে শুধু শিক্ষিত মুসলমানরাই এগিয়ে আসলে চলবে না ; শিক্ষিত হিন্দুদেরও এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “মুসলিম সাহিত্য সমাজ কোন একটি বিশিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়, কিংবা এ কোন এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য গঠিত হয়নি।” মানবকল্যাণে আবুল হোসেনের ভাবনা ছিল উপযোগবাদী। আবুল হোসেন যদিও নিজে কমিউনিস্ট ছিলেন না তবুও তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। তিনি সমাজের কৃষক, দিনমজুর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের মঙ্গল কামনা করেছেন।
তৎকালীন মুসলিম সমাজে আবুল হোসেনের দর্শনের প্রভাব : আবুল হোসেন একজন প্রগতিশীল দার্শনিক হিসেবে তৎকালীন সময়ে ইসলাম ধর্মে যেসব কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল, তিনি সেসবের
বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেন এবং বাঙালি মুসলিম সমাজের উন্নতিতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে গেছেন। সাধারণ বাঙালি জনগণ তাঁর এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানালেও তৎকালীন কিছু গোঁড়া রক্ষণশীল তথাকথিত ধর্মের রক্ষক বলে পরিচয়দানকারী কিছু ইসলামপন্থি ব্যক্তিত্ব একে ইসলাম ধ্বংসকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে। তারা বিভিন্নভাবে আবুল হোসেনের দর্শনকে সমালোচনা করতে লাগল এবং এক পর্যায়ে তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এটা বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসে একটি
কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু এতে আবুল হোসেনের চিন্তাচেতনা থমকে গেলেও নিভে যায়নি। তিনি কলকাতা থেকেও দর্শন চিন্তা করে গেছেন। তিনি ছিলেন সাহসী মনের মানুষ। তাই অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তিনি বাঙালি মুসলিম সমাজের উন্নতিকল্পে তাঁর চিন্তাচেতনাকে বিধৃত করেন।
এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ তাঁর ‘বাঙলার মনীষা’ গ্রন্থে বলেছেন, “শিখা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন আবুল হোসেন। তিনি ছিলেন সংস্কারক, বিবেকবান পুরুষ। তাই তাঁর স্বল্পকালীন জীবন নিবেদিত ছিল স্বদেশের,
স্বসমাজের, স্বজাতির কল্যাণ চিন্তায় ও হিত সাধনে। দেশ, মানুষ, ধর্ম, ন্যায় ও কল্যাণ সম্বন্ধে তাঁর চিন্তাচেতনায় কিছু কিছু অনন্যতা ছিল।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা আবুল
হোসেন চিন্তার জগতে নিজেকে একজন যুক্তিবাদী, উদারতাবাদী এবং মানবতাবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অন্ধবিশ্বাস
ও কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাচেতনায় যুক্তিবুদ্ধির আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আজীবন চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই যুক্তিবাদী, উদারতাবাদী এবং মানবতাবাদী চিন্তাধারা বর্তমান কালের প্রায় সকল বাংলাদেশ দার্শনিকদের চিন্তাচেতনায় প্রতিফলিত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাই বলা যায়, দার্শনিক আবুল হোসেনের অবদান
বাংলাদেশ দর্শনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।