রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রহস্যবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যের আলোকে রহস্যবাদ আলোচনা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যের আলোকে রহস্যবাদ বর্ণনা কর।
উত্তর।। ভূমিকা :
সমাজের উচ্চাসনে আসীন হয়েও যিনি অবহেলিত,উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভেবেছেন, যাঁর জন্ম বাঙালি জাতির গর্ব, তিনিই হলেন বাংলাদেশ দর্শনের অর্থসৈনিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ দার্শনিকদের মতো চিন্তা করেন নি, অথচ তাঁর চিন্তা যুক্তিহীন নয়। তাঁর মধ্যে এমন একটা সূক্ষ্ম বোধশক্তি ছিল, যা তাঁর সকল কল্পনার মধ্যে মনস্বিতা সঞ্চার করেছে। অন্ধ আবেগের বদলে যুক্তিসিদ্ধ কল্পনাকে তিনি তাঁর সমগ্র সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। ধর্ম নিয়ে তিনি বলেছেন, ধর্ম মানে মানুষের ধর্ম। শ্রদ্ধাচারে যোগাসনে নয়, আত্মত্যাগে ও সেবাধর্মের
মাধ্যমেই মানুষ পারবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে, অসীমের সন্ধান পেতে। এ থেকে বলা যায়, তিনি ছিলেন উচ্চমানের দার্শনিক কবি।
রবীন্দ্রনাথের রহস্যবাদ : সকল শ্রেষ্ঠ দার্শনিকই রহস্যবাদ বা এ রহস্যময় পৃথিবীর আত্মজিজ্ঞাসা তাঁদের তন্ময়তার বাণীর মাধ্যমে আমাদের নিকট বিবৃত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবন প্রভাতেই জানতে পেরেছেন যে, পার্থিব সংকীর্ণতার মায়ামোহ কারাগার প্রকাণ্ড আকার হয়ে, তাঁকে চারদিকে বেষ্টন করেছে। তাই তিনি বলেছেন,
“ওরে চারিদিকে মোর
একি কারাগার ঘোর-
ভাড় ভাড় কারা, আঘাতে আঘাত কর,
ওরে আজ কি গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবির কর।”
নবজীবন বা অন্তৰ্জীবন বলতে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন মনুষ্যত্বের উপলব্ধি। তিনি বলেছেন, মননের দ্বারা আমরা যে অন্তর্জীবন লাভ করি তার মূল লক্ষ্য পরমার্থ। এ আমমহল ও খাসমহলের দু’টি কথা স্বার্থ ও পরমার্থ। সকল মানুষ নয়; মানুষের মধ্যে যাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ, যথার্থ হিসেবে তাঁদেরই আত্মা আছে। জীবন প্রভাতেই প্রাণ নির্ঝরের পার্থিব মায়ামোহের স্বপ্ন হতে রবীন্দ্রনাথের অব্যাহতি লাভ, এটা তাঁর কবি জীবনের এক আশ্চর্য ঘটনা। এ নবজীবন প্রাপ্তিকে রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভাষায় তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া।”
তিনি বলেছেন,
আমি যাব, আমি যাব, কোথায় যে কোন দেশ-
“জগতে ঢালিব প্রাণ,
গাহিব করুণ গান,
উদ্বেগ অধীর হিয়া
সুদূর সমুদ্রে গিয়া
সে প্রাণ মিশাব আর সে গান করিব শেষ।”
বৈষ্ণব প্রেমধর্মের যে রূপটি তাঁর পদাবলিতে দেখেছিলেন, তারই অনুধ্যান করেছেন তিনি পরবর্তী কয়েকটি কাব্যে। প্রকৃতির অনেক দৃশ্যই কবির ছন্দ ঝংকার এনে দেয়। বৈষ্ণব পদাবলির মর্মের ভিতর সে প্রবেশ করেছে। তিনি বলেছেন,
“নিখিলের সুখ নিখিলের দুঃখ
নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে।
সকল প্রেমের স্মৃতি-
সকল কালের সকল কবির গীতি।”
পরম পুরুষের ইচ্ছাশক্তিই শক্তিরূপিণী মহাকালরূপে বারে বারে তাঁর প্রকাশ ও বিনয় সাধন করেছে। রবীন্দ্রনাথের শক্তির উৎস মহাদেব, মহাকাল। পুরাণে উক্ত মহাকাল পদতলে অসুর, দলনী, বিজয়িনী, পাষাণী, করালীকালী মূর্তির প্রকৃষ্ট তত্ত্বটি সুন্দরভাবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিকট প্রকাশ করে দিলেন। তিনি শক্তিরূপিণী ইচ্ছাশক্তির মাহাত্ম্য ‘নারীর দান’ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন এভাবে-
“কি ধন তুমি করিছ দান
না জান আপনি।
পুষ্পসম অন্ধ তুমি
অন্ধ বালিকা
দেখনি নিজে মোহন কি যে
তোমার মালিকা।”
বিশ্বপ্রেমই সংকীর্ণতার আবরণে ধূলিসাৎ হয়ে মানবীয় প্রেমে বা আরও সংকীর্ণতার স্বার্থপূর্ণ পতপ্রেমে ক্ষণকালের ধন্য আবিলতায় আচ্ছন্ন হয়। রবীন্দ্রনাথের এ দেবতাকে প্রেয়সীভাবে গ্ রহণ করা হলে ক্রমেই তা স্বার্থলেশশূন্য বিশ্বপ্রেমে রূপরে লাভ করে। তিনি বলেছেন,
“যদি অন্তরে লুকায়ে বলিয়া
হবে অন্তরজয়ী,
তবে তাই হোক। দেবী অহরহ
জনমে জনমে রহ তবে রহ,
নিজে মিলনে নিত্য বিরহ
জীবনে জাগাও প্রিয়ে।
নব নবরূপে ওগো রূপময়,
লুণ্ঠিয়া লহ আমার হৃদয়।”
জগতের মধ্যবর্তী সে নিত্য পদার্থের নাম ব্রহ্ম এবং জীবের অন্তরস্থিত ধ্রুবসত্তা বুদ্ধি, বাসনা প্রভৃতি মায়া দ্বারা ব্রহ্ম হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আত্মাকে যে দিতে পেরেছে আত্মা সর্বতোভাবে তারই। রবীন্দ্রনাথ সে আত্মারই সন্ধান লাভ করেছেন। সৌন্দর্য পিয়াসী রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন,
“মনে সাধ যেদিকে চাই
কেবল চেয়ে রব।
দেখিব শুধু দেখিব শুধু
কথাটি নাহি কব।
পরানে শুধু জাগিবে প্রেম
নয়নে লাগে ঘোর
জগতে যেন ডুবিয়া রব
হইয়া রব ভোর।”
আমার সমস্ত মন এমন বিমুখ হলো যে, কটাক্ষেও তাঁর দিকে তাকাতে চাইতাম না। তারপরে এমন হয়েছে যে, যখন সকাল বেলায় তাঁকে প্রণাম করি তখন কেবল তাঁর পায়ের তলার মাটির দিকেই তাকাই আর মনে হয় আমার নয়ন সার্থক হয়ে গেছে। পাপ-পুণ্যের স্বরূপ সম্পর্কে কবি বলেছেন,
হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালো মন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ।
কি আনন্দ, কি আনন্দ, কি আনন্দ।
এভাবেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রহস্যবাদ ব্যাখ্যা করেন।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, এ জগৎ এক রহস্যময় জায়গা। এ রহস্য উদ্ঘাটন কোন কাব্য বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধাদির মাধ্যমে সঠিকভাবে সম্ভব নয়। তারপরও অনেকে এর মধ্যেও এ রহস্যের সন্ধান করেছেন। এ গূঢ় রহস্যের মাধুরী তাঁদের কাব্য বা বাণীর মধ্যেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে। আর সে অধ্যাত্ম সাধক, রহস্যবাদের প্রকাশক ছিলেন বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁর সাহিত্য জীবন নদীর স্রোতের ন্যায় আমাদের মরুতৃষ্ণা প্রাণতটে নানা ছন্দ রূপ ও গানে, কত অপরূপ ভঙ্গিতেই সেই তত্ত্বকথা গেয়ে গেছেন, তা ভাবলে অবাক লাগে। এ তত্ত্ব আলোচনা কবিকে এক আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছে দিয়েছে, যার জন্য তিনি সমগ্র জীবন সত্যের সন্ধান করেছেন।