অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজদর্শন সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজদর্শন সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজদর্শন তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মানবতার জয়গান নিয়ে যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন, সমাজের উচ্চাসনে আসীন হয়েও যিনি অবহেলিত, উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভেবেছেন, তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বাঙালি জাতির গর্ব। তাঁর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বোধশক্তি ছিল, যা তাঁর সকল কল্পনার মধ্যে মনস্বিতা সঞ্চার করেছে।
অন্ধ আবেগের বদলে যুক্তিসিদ্ধ কল্পনাকে তিনি তাঁর সমগ্র সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন। আর এটিই তাঁকে একজন প্রকৃত দার্শনিকের মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর দর্শন মানবতাবাদী দর্শনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজদর্শন বা সমাজচিন্তা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজদর্শনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর সমাজদর্শনের মূল বিষয় ছিল মানুষ। কিভাবে মানুষের মুক্তি হতে পারে- এ ছিল তাঁর সমাজদর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয়। নিম্নে তাঁর সমাজচিন্তার বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হলো :
১. মুক্তচিন্তার প্রতীক : রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মুক্তচিন্তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির অধিকারী। তাই তিনি সমাজের প্রত্যেক মানুষকে মুক্তচিন্তার অধিকারী হওয়ার প্রতি আগ্রহ যুগিয়েছেন। মুক্তচিন্তা ছাড়া সমাজের ও দেশের উন্নয়ন যে সম্ভব নয় তাই তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় তুলে ধরেছেন।
২. সুশৃঙ্খল সমাজ : রবীন্দ্রনাথ সবসময় সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। তাঁর মতে, সমাজ যদি সুশৃঙ্খল হয়, তবে প্রত্যেক মানুষ তার নিজ নিজ কর্তব্য সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারবে। প্রত্যেক মানুষ পাবে নিজের অধিকার। ফলে সমাজের উন্নয়ন হবে।
নারীরাও
৩. নারী-পুরুষের সমতা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজে নারী-পুরুষের সমতার কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, সমাজের অংশ। কাজেই নারী জাতির উন্নয়ন ছাড়া সমাজের উন্নয়ন কোনোভাবেই আশা করা যায় না। সমাজের উন্নয়নের জন্য তাই তিনি নারী-পুরুষের সম অধিকারের কথা বলেন।
৪. সামাজিক ও রাজনৈতিক নিপীড়ন : রবীন্দ্রনাথ সামাজিক ও রাজনৈতিক নিপীড়নে অত্যন্ত ব্যথিত হতেন। তিনি মানুষকে ভাই ভাই’ বলে মনে করেন। কাজেই এক ভাই অপর ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারে না। সেজন্য তিনি সমাজ থেকে সকল প্রকার অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানান।
৫. অধিকার আদায়ে সচেতন : তিনি সকল মানুষকে আপন অধিকার আদায়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়। তাই তিনি সাধারণ মানুষকে আপন অধিকারে সচেতন করে সমাজ থেকে সকল অসংগতি দূর করার কথা বলেন।
৬. সামাজিক শিক্ষা : শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কথাটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি সমাজের সকল মানুষকে শিক্ষাবিস্তারে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি শিক্ষাবিস্তারে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের
উপর জোর দেন। তিনি বিদ্যালয়ের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, আনন্দহীন শিক্ষা মূল শিক্ষা নয়। তাই শিক্ষাবিস্তারে তিনি প্রত্যেক শিশুর স্বাধীনভাবে শিক্ষা গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন।
৭. সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকল প্রকার অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, সমাজের উন্নয়নের অন্তরায় হলো অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার। তাই এসব থেকে সমাজকে দূরে রাখার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং ব্যবহারিক শিক্ষা। ব্যবহারিক শিক্ষাই সমাজ থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস দূর করতে পারে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, মানবপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমাজদর্শনে মানুষের মুক্তি নিয়েই আলোচনা করেছেন। মানুষের মুক্তির জন্য তিনি সমাজের সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। সমাজের সকল মানুষ সমঅধিকার ভোগ না করলে সমাজে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে তা তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এ অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।