রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ সম্পর্কে টীকা লেখ ।

অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মানবতাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত কী?
উত্তর।৷ ভূমিকা :
আকাশের সাথে যেমন কোনোকিছুর তুলনা করা যায় না, তেমনি রবীন্দ্রনাথের সাথে কারও তুলনা করা যায় না। এ আকাশতুল্য যোগ্যতার জন্য তিনি ‘বিশ্বকবি’ খেতাব লাভ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে যাদের কণ্ঠে মানবতার জয়গান শোনা যায়, তাঁদের মধ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রেম ও মৈত্রীর মহামিলনের পথে এক ডাবসমন্বয়ের মাঝে বিশ্বমানব চিত্রের শুভ উদ্বোধন করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ১৮৬১ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোর এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, তথাপি গরিবদের দুঃখকষ্ট তাঁর মনকে নাড়া দিয়েছে সময়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ : নিম্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদ আলোচনা করা হলো :
১. কাব্যে মানবতাবাদ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে মানবতার কবি ছিলেন তা তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে বিশদভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বিভিন্ন কাব্যে আমরা মানবতার জয়গান দেখতে পাই। তাঁর প্রথম দিকের কাব্যগুলোর মধ্যে ‘চৈতালী’ (১৮৯৫) কাব্যের কবিতাগুলোতে তাঁর মানবতাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছে, ‘পুনশ্চ’ কাব্যে কবির মানবতার সুর আরও সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এ কাব্যে সাধারণ মানুষের সহজ সরল জীবন ফুটে উঠেছে। সাঁওতাল মেয়ে, ক্যামেলিয়া,
অন্তঃপুরের সাধারণ মেয়ে, এরা কেউ কবির দৃষ্টির আড়ালে পড়েনি। তাঁর বিভিন্ন কবিতা ও গানে মানবতার সুর দেখা যায়। যেমন-
“যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার বাজে-
সবার পিছে, সবার নীচে
সর্বহারাদের মাঝে।” [গীতাঞ্জলি : কবিতা নং-১০৭]
২. ধর্মীয় মানবতাবাদ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি স্রষ্টার সাথে মানুষের প্রেমের কথা বলেছেন। তিনি ‘পুনশ্চ’ কাব্যে মানুষ ও স্রষ্টাকে পরস্পর নির্ভরশীল করে অঙ্কিত করতে চেষ্টা করেছেন। ‘বলাকা’ (১৯১৬) কাব্যের ৩১নং কবিতায় ধর্মীয় মানবতাবাদ ফুটে উঠেছে।
“তৃণদল
মাটির আকাশ পরে ঝাপটিছে ডানা।
মাটির আধার নিচে’ কে জানে ঠিকানা,
মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা।” (বলাকা)
কবি মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে চিত্রিত করার জন্যই অলংকার বা উপমা ব্যবহার করেছেন। ঈশ্বর যেমন জীবের মিলন পিয়াসি, জীবও তেমনি পরমাত্মার জন্য তৃষ্ণার্ত। তিনি স্রষ্টার সাথে প্রেমের চিত্র তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যে তুলে ধরেন। যেমন-
“পুষ্প যেমন আলোর লাগি

না জেনে রাত কাটায় জাগি
তেমনি তোমার আশায় আমার
হৃদয় আছে ছেয়ে।” (গীতাঞ্জলি)
৩. বিশ্বমানবতাবাদ : বিশ্বমানবের সাথে ব্যক্তিমানবের যোগসূত্র স্থাপন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মানবসমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বিশ্বমানবতাবাদ। তাঁর মতে, “বিশ্বমানবের সাথে মিলনের মাধ্যমেই মানুষের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে। এ মিলনের ফলেই মানবসত্তার স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটে।” তাঁর ‘Religion of Man’ পুস্তকে বিশ্বমানবতার চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, বিশ্ব ভাবের এ মহৎ আদর্শের মধ্য দিয়ে মানুষ চলে এক পরিপূর্ণতার পথে। যেদিকে সে বিচ্ছিন্ন নয়, যেদিকে তার পূর্ণতা, সেদিকে ব্যক্তিগত সীমাকে ছাড়িয়ে চলেছে বিশ্বমানব।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ছিল বিশ্ব মানবের বন্ধু। মানবতার জয়গান তাঁর কবিতা, উপন্যাস ও গানের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। মৃত্যুর মাত্র সাতদিন আগে তিনি লিখেন,
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ
আকীর্ণ করি,
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী।”