উত্তর : ভূমিকা: যে-কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিছু উপাদানের উপর নির্ভরশীল। সেগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মৌলিক উপাদান বলা হয়। দেশ ও সময় ভেদে এ উপাদানগুলোর বিভিন্নতা থাকলেও উন্নয়নের পেছনে সে শক্তি গুলো সব দেশেই প্রযোজ্য।
ক) অর্থনৈতিক উপাদান ও (খ) অ-অর্থনৈতিক উপাদান।
মৌলিক উপাদনসমূহঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মৌলিক উপাদানসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
নিম্নে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উভয় প্রকার উপদানসমূহ আলোচনা করা হলো:
(ক) অর্থনৈতিক উপাদানঃ অর্থনৈতিক উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করলে এর কতগুলো উপাদান লক্ষ্য করা যায়। নিম্মে প্রধান উপাদানগুলো আলোচনা করা হলো:
১. প্রাকৃতিক সম্পদ : অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সহজলভ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলে উৎপাদন বাড়ে না। উন্নয়নও হয় না। প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া কেউ এত বেশি উন্নত হতে পারত না।
২. দক্ষ জনশক্তি:দেশের প্রাকৃতির সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। দেশের জনশক্তি দক্ষ হলে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভবপর হবে।
৩. মূলধন সংগ্রহঃ উন্নয়নের মূলকথা হলো মূলধন সংগ্রহ। উপকরণকে সঠিকভাবে পরিবর্তিত করে শ্রম। কিন্তু শুধু হাতে সে কাজ করে না। অনেক নিপুণ যন্ত্রপাতির সাহায্য দরকার হয়। এই ধরনের মূলধন না থাকলে উৎপাদন কম হয়।
৪. প্রযুক্তিগত উন্নতি: উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় এবং উৎপাদনের পরিমাণগত ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। সুতরাং সমাজে বিদ্যমান প্রযুক্তিগত স্তরের উপর উন্নয়নের হার নির্ভরশীল।
৫. অবকাঠামোগত অবস্থা: কোন দেশের উন্নয়নের জন্য অবকাঠামেরগত উন্নয়ন প্রারন্তেই প্রয়োজন। অবকাঠোমোগত উন্নয়ন হলে সহজেই শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়ন হবে। তাই উন্নত অবকাঠামোই পারে উন্নত অর্থনীতির ভিত্তির সূচনা করতে।
৬. শিক্ষা বিস্তারঃ শিক্ষা অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ জনগণ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে উন্নয়নে তাদের সক্রিয় অংশ গ্রহণ পাওয়া যায় না। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে শিক্ষা
বিস্তার করতে হবে।
৭. দক্ষ উদ্যোক্তা শ্রেণিঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দক্ষ উদ্যোক্তা শ্রেণি উৎপানশীল ও সৃজনশীল ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতিবিদ সুম্পিটারের মতে, আধুনিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উদ্যোক্তা শ্রেণির ভূমিকা সর্বাধিক।
৮. উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা: উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মৌলিক উপাদান। যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৯. আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতিঃ দেশের উন্নয়নে বলিষ্ঠ কেন্দ্রী ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের যথোপযুক্ত উপস্থিতি থাকা বাঞ্চনীয়। এরূপ আর্থিক প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত মূলধন সরবরাহ করতে পারে।
১০. প্রতিযোগিতামূলক বাজার: প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অস্তিত্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাজারে প্রতিযোগিতা থাকলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং সম্পদের পূর্ণ নিয়োগ লাভের পথ সুগম হয়। এতে দেশের কর্মনিয়োগস্তর ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়।
১১. বৈদেশিক মুদ্রার প্রভাব: দেশে প্রয়োজনীয় শিল্প স্থাপনের জন্য বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি এবং কলা কৌশল আমদানি করতে হয়। কিন্তু রপ্তানি বাণিজ্য শক্তিশালী না হওয়ায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অভাব রয়েছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধা গ্রন্থ হচ্ছে।
১২. জনসংখ্যার প্রভাবঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশে জনাধিক্য থাকবে না। জনসংখ্যা কাম্য স্তরে থাকা উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের চেয়ে অর্থনৈতিক হার বেশি হয় তবে উন্নয়ন অর্জন সম্ভব।
(খ) অ-অর্থনৈতিক উপাদানঃ অ-অর্থনৈতিক উপাদানসমূহকে বিশ্লেষণ করলে এর কতগুলো উপাদান লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে প্রধান প্রধান উপাদানসমূহ আলোচনা করা হলোঃ
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একান্ত আবশ্যক। জনগণের সমর্থনে যে-কোনো সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত থাকলে রাজনৈতিক ও সামাজিক শৃংঙ্খলা বিদ্যমান থাকে। এ অবস্থায় শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত উন্নতি সাধন সম্ভবপর হয়ে উঠে।
২. অনুকূল সামাজিক ধর্মীয় পরিবেশঃ অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়া হওয়ায় তা বহুলাংশে সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। জাতিকে প্রথা, কুসংস্কার গোঁড়ামী, অদৃষ্টবাদিতা, পর্দা প্রথা ইত্যাদি বিষয়গুলো উন্নয়নের গতি রোধ করে।
৩. জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি: জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির উপর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক।
৪. আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা :দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। দেশের প্রচলিত আইন-কানুন জনসাধারণের ধন-সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করতে পারলে জনসাধারণ নিবিঘ্নে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে। এতে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
৫. প্রশাসনিক দক্ষতাঃ সম্পদ/মূলধন থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে এমন কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কাজ মূলধন বা সম্পদ বণ্টন হতে হবে। দক্ষ বণ্টন ব্যবস্থা থাকলে নিয়োগ, জাতীয় আয় ইত্যাদি দ্রুত বাড়বে।
৬. জনস্বাস্থ্যঃ জনস্বাস্থ্য যে-কোনো দেশের জন্য খুবই মূল্যবান সম্পদ। যে জাতি দেশের জনগণের স্বাস্থ্যের প্রতি যত বেশি যত্ন নেয় সে জাতির জনগণ তত বেশি শক্তিশালী ও কর্মদক্ষ হয়। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সে জাতি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
৭. জাতীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা: কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা নিতান্ত অপরিহার্য। জাতীয় নেতৃবৃন্দ যেমন- সমাজের রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ডাক্তার, প্রকৌশলীবিদকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছার পোষণ করে তাহলে অর্থনীতিকে উন্নয়নের পথে অকেটাই প্রসারিত করা যায়।
৮. শহরায়ন:শহরায়নের পরিমান কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রভারিত করে থাকে। দেশের শহরায়ন যত বেশি হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তত বেশি প্রাণ সঞ্চার হবে।
উপসংহার: অর্থনৈতিক উন্নয়ন এমন একটি জটিল ও ব্যাপক প্রক্রিয়া যা অর্থনৈতিক উপাদান ছাড়াও বহুমুখী সামজিক ও রাজনৈতিক বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়।