অথবা, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা যে কোন সরকার ব্যবস্থায় যে নল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে যে দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আর সংখ্যা দল বিরোধী দল হিসেবে পার্লামেন্টে অবস্থান গ্রহণ করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী দল সরকারি নীতি ও কর্মকারের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে এবং সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের গঠনমূলক সমালোচনা করে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা : আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অপরিহার্য। Prof. Laski বলেছেন, “The function of the opposition is to oppose ” কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধিতা ছাড়াও বিরোধী দলের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে, যা নিম্নে বর্ণিত হলো।
১. ক্ষমতাসীন সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা: ক্ষমতাসীন সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা বিরোধী দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি নিয়ন্ত্রণ সাধারণত সমালোচনার মাধ্যমে বিরোধী নন কার্যকর করে থাকে। সরকারি কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় বিরোধী দল সর্বদা তৎপর থাকে বলে মন্ত্রিগণও সর্বদা তাদের কর্মকালের দিকে সতর্ক থাকেন। অনেক সময় বিরোধী
দলের চাপের মুখে সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত কমিটি ও কমিশন গঠন করতে হয়।
২. সংসদীয় কাজকর্মে অংশগ্রহণ: বিরোধী দল পার্লামেন্টের কাজকর্মে অন্মগ্রহণ করে থাকে। পার্লামেন্টের কর্মসূচি বিরোধী দলের সাথে আলোচনাক্রমে ঠিক করা হয়। ফলে জনগণের স্বার্থ পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষিত হয়।
৩. জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি : আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টিতে বিরোধী দলের ভূমিকা
অপরিসীম। বিরোধী দল জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সংকীর্ণতা দূর করে জাতীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশপ্রেম ও স্বজনপ্রীতি সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় সংহতি ও ঐকা সৃষ্টি করে।
৪. গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে: রক্ষার অগ্রদূত হিসেবে বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাষ্ট্রের মধ্যে কোন সমস্যা বা গোলযোগ দেখা দিলে শক্তিশালী বিরোধী দল তা শান্তিপূর্ণ উপায়ে মোকাবিলা করে থাকে।
৫. স্বৈরাচারের পথ রুদ্ধ করা: বিরোধী দল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। বিরোধী দল সরকারের
গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারের স্বেচ্ছাচারী বা স্বৈরাচারী প্রবণতাকে রোধ করে। সরকারি দল বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে স্বৈরাচারী হতে পারে না। কেননা স্বৈরাচারী কিছু আগে জনগণের সমর্থন হারানোর ভয় থাকে।
৬. রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার: বিরোধী দল রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাজেট অধিবেশন, আমদানি-রপ্তানি, পররাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয় ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা করে জনগণকে সচেতন করে তোলে।
৭. আইন প্রণয়নে সহায়তা: আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিরোধী দল সরকারি নলকে অনেক সময় সহযোগিতা করে থাকে। বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন ছাড়া আইন প্রণয়ন সম্ভব হয় না। আর এক্ষেত্রে বিরোধী সরকারি দলকে সমর্থন দানের মাধ্যমে আইন প্রণয়নে সহায়তা করে।
৮. জনমত গঠন : সরকারি কর্মকার সম্পর্কে জনসমক্ষে প্রচার করার লক্ষ্যে বিরোধী দলীয় সদস্যগণ আইনসভার বাইরে সভাসমিতির আশ্রয় গ্রহণ করে। তারা নিজেদের বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে জনসমক্ষে সরকারি সিদ্ধান্তের ভালোমন দিক তুলে ধরেন। এভাবে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠে।
৯. বিকল্প কর্মসূচি পেশ : বিকল্প কর্মসূচি পেশ করার ক্ষেত্রেও বিরোধী দলের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সাধারণত নির্বাচনের পূর্বে বিরোধী দলের পক্ষ হতে এ ধরনের কর্মসূচি জনসমক্ষে প্রচার করা হয়। ফলে জনগণ দুই বা ততোধিক কর্মপন্থার কোনটি উত্তম তা বেছে নিতে পারে।
১০. সরকারের পরিবর্তন: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন। আ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনে বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ত্রুটিবিচ্যুতিসমূহ জনসম্মুখে তুলে ধরে এবং জনমতকে সপক্ষে পরিচালনার মাধ্যমে বিরোধী দল সরকার পরিবর্তনে সাহায্য করে।
১১. সমস্যা নির্ধারণ ও প্রতিকার নির্দেশ: দেশের বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা নির্ধারণ ও তার প্রতিকারের সঠিক উপায় নির্ণয় করে বিরোধী দল সময় জাতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বিরোধী দল সরকারকে সমস্যা সমাধানের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
১২. বিকল্প সরকার: বিরোধী দলই হচ্ছে বিকল্প সরকার। ক্ষমতাসীন সরকারের কোন দুর্বলতা দেখা দিলে বিরোধী দল বিকল্প সরকার গঠনের চিন্তাভাবনা করে।
১৩. ভোটদানে সহায়তা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দল ভোটারদেরকে ভোটের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিতকরণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
১৪. যোগ্য ও দরিদ্র প্রার্থীদের সাহায্য করা : সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সামর্থ্যের অভাবে অনেক দরিদ্র ও মেধাবী প্রার্থীগণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না। এক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলো তাদের সার্বিক সাহায্য করে থাকে।
১৫. সরকারকে আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল আইনসভার ভিতরে বিতর্ক, নিদাপ্রস্তাব, মুলতবি ইত্যাদির মাধ্যমে এবং আইনসভার বাইরে জনসভা, বক্তৃতা, বিবৃতি ও সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের অস্তিত্ব এবং ভূমিকা অনস্বীকার্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পূর্ণ বিকাশ ও কার্যকারিতার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ভূমিকার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলকে ‘Her Majesty’s Opposition’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এজন্য Prof. Jennings বলেছেন, “If there is no opposition, there is no democracy.”