বাংলাদেশের ভূমি সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর ।

বাংলাদেশের ভূমিসংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর ।
অথবা, বাংলাদেশের ভূমিসংস্কার ব্যবস্থা আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের তুমিসংস্কার বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের ভূমিসংস্কার ব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান তা উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভূমিসংস্কার বলতে অনেকে মনে করেন ভূ-স্বামীদের থেকে অতিরিক্ত জমি নিয়ে ক্ষুদ্র কৃষক বা ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করা। আবার কেউ কেউ ভূমিসংস্কার বলতে বুঝেন জমির উন্নয়ন, উন্নত চাষাবাদ করার উপকরণ সরবরাহ করা, সমবায় বা রাষ্ট্রীয় খামারের আওতায় নিয়ে চাষাবাদ করা। কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী মনে
করেন, সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য নেয়া, জনগণের সমর্থনের জন্য একজন থেকে নিয়ে বহুজনকে দেয়া বা এতে রাষ্ট্রীয়
প্রশাসন জনগণের সমর্থন পায়। বাংলাদেশের ভূমিসংস্কার : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর পরই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের সরকার ভূমিসংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা কমিয়ে ১০০ বিঘায় নামানো হয়।
সকল বকেয়া খাজনা সুদসহ মওকুফ করা হয় এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদের খাজনা মওকুফ করা হয়। এছাড়া সালামি
ব্যতীত খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নদীতে জেগে উঠা চর জমির উপর নদীর পাড়ের মালিকদের
অধিকার বিলোপ করে চর এলাকার জমি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। হাট বাজার ইজারা দেয়ার ব্যবস্থা রহিত করে তার
পরিবর্তে ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা সমন্বয়ে পরিচালনা কমিটির কাছে হাটবাজার পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় ।এরশাদ সরকারের সময়কালে ভূমিসংস্কারের ব্যবস্থা নেয়া হয়। জমির সর্বোচ্চ মালিকানা ৫০ বিঘায় নামানো হয়। খাসজমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। বর্গাদারি চুক্তি ন্যূনতম ৫ বছর এবং ফসল ভাগের ক্ষেত্রে ১
ভাগ জমির মালিক, ১ ভাগ বর্গাচাষি ও ১ ভাগ যার উপকরণে চাষ হবে তার এ নীতি চালু করা হয়। কিন্তু এবারও ভূমি
সংস্কারের প্রয়োগ খুব বেশি করা যায়নি। ১৯৮৩ সালে ভূমিসংস্কারের জন্য যে কমিটি গঠিত হয় তা অকার্যকর ছিল। ১৯৮১ সালে জমির আইল তুলে দেবার উদ্যোগ নেয়া হয় যা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮৪ সালে ভূমিসংস্কার আইন ও বিধি বলে খাসজমি পুনঃসংস্কার করে ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টনের যে ব্যবস্থা করা হয় তা মূলত ছিল গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচি নামক ভূমিহীন পরিবারের পুনর্বাসিত করার একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি। ভূমি সংস্কারে করণীয় ব্যবস্থাদি : একটি গতিশীল উৎপাদন পদ্ধতি বিনির্মাণের জন্য ভূমিসংস্কার ব্যবস্থায় যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন সেগুলো নিম্নরূপ :
১. ভূমির মালিকানা : একথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি কাঠামোতে জমির মালিকানায় অসমতা বিদ্যমান। স্বল্পসংখ্যক ধনী শ্রেণির হাতে জমি উৎপাদনের উপকরণ ও অর্থের কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। ক্ষুদ্র কৃষক ক্রমান্বয়ে তাদের জমি হারাচ্ছে। ভূমি মালিকানার এই যে মেরুকরণ তা থেকে উত্তরণের জন্য সমাজবিজ্ঞানীরা ভূমিসংস্কার করে
সিলিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনী শ্রেণির হাত থেকে জমি নিয়ে ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের সুপারিশ করেন।
২. ক্ষুদ্র ভূমি মালিকানা : যারা ক্ষুদ্র ভূমির মালিক তাদের পুঁজির অভাব থাকায় উৎপাদন উপকরণ সংগ্রহ করা সম্ভব্ হয় না। বিশেষ করে আধুনিক কৃষি উপকরণ যথা : সেচ, উন্নত বীজ, ট্রাক্টর, সার ইত্যাদি সংগ্রহ করে জমিতে প্রয়োগ করা এবং এর মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ক্ষুদ্র জোতগুলোতে সম্ভব হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে ভূমি সংস্কারের পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।৩. একই মালিকের বিভিন্ন স্থানে জমি থাকা : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধনী কৃষকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমি বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকে। এজন্য ধনী কৃষক বর্গাচাষের সহায়তা নেয়। এতে ধনী কৃষকের খাজনা আদায় অধিক
হলেও কৃষি উৎপাদন কম হয়। তাই ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে যদি খণ্ডিত জমিকে একত্রিত করে চাষের পরিকল্পনা করা হয়, তবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ৪. অনুপস্থিত ভূমি মালিক : বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ কাঠামোতে উচ্চ মর্যাদার প্রতীক হিসেবে ধনী কৃষকরা জমিতে
সরাসরি কায়িক পরিশ্রমে চাষাবাদ করেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা জমি বর্গায় চাষ করান অথবা মজুরি শ্রমিক নিয়োগ করে
চাষাবাদ তত্ত্বাবধান করেন। ধনী কৃষকের হাতে জমি পুঞ্জীভূত থাকায় এ প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ জমিতে উৎপাদন হ্রাস পায়।
৫. বর্গাচাষ সমস্যা : বাংলাদেশে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কে বর্গা প্রথা অন্যতম। কিন্তু এ বর্গাপ্রথা অনেকটাই অনুৎপাদনশীল। কেননা প্রচলিত বর্গাপ্রথায় ফসলের অর্ধেক জমির মালিককে দিয়ে দিতে হয় বলে বর্গাচাষি কৃষি উৎপাদনে আগ্রহী হয় না। মালিক বীজ, সার, সেচ ইত্যাদির ব্যয়ভার বহন না করায় কৃষকদের উপর অর্থনৈতিক চাপ থাকে প্রবল।
তার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশে ফসলহানি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।
৬. মূলধন ও কৃষি উপকরণে ব্যবস্থা : বাংলাদেশে ধনী কৃষক, প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব একই সাথে ঋণের ব্যবসায় ও কৃষি উপকরণ আত্মসাতে জড়িত। সার, বীজ প্রভৃতি নিয়ে প্রতি বছর এ দেশের সাধারণ কৃষকরা ভোগান্তির শিকার হয়। কৃষি কাঠামোতে যখন উৎপাদন সম্পর্কের এমন অবস্থা তখন ভূমিসংস্কারের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব
এ উৎপাদন সম্পর্ক ভেঙে কৃষি উৎপাদনকে আধুনিক করা।
৭. বাজারের বিকাশ : কৃষক যদি তার উৎপাদিত পণ্য নিয়ে সঠিক দামে বাজারে যথাসময়ে প্রবেশ করতে স্বাধীনতা ভোগ না করে তবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হতে বাধ্য। বাংলাদেশের বাজারের উপর ধনী কৃষকদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। ধনী কৃষক বা মধ্যস্বত্ব ভোগীরা কমদামে কৃষকের পণ্য ক্রয় করে বেশি দামে তা বাজারে বিক্রি করে। বাজারে অবাধ
প্রবেশাধিকার মধ্যস্তত্বভোগীদের উৎখাত ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেমন- রাস্তা, যানবাহন ইত্যাদি উন্নয়ন করে একটি ভূমিসংস্কার নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
৮. খাসজমি : সরকারের অনেক অব্যবহৃত খাসজমি রয়েছে ভূমিসংস্কারের লক্ষ্য হওয়া উচিত ভূমিহীনদের সমবায়
গঠন করে খাসজমি বণ্টন করা এবং একই সাথে ভূমিহীনদের সমবায়কে সহজ শর্তে ঋণ, পুঁজি ও উন্নত কৃষি উপকরণ্ সরবরাহ নিশ্চিত করা। পূর্বে রাষ্ট্র মালিকানায় যেসব হাওর, জলমহল ছিল তাতে ভূমিহীনরা বিনামূল্যে মাছ সংগ্রহ করতে পারতো। কিন্তু বর্তমানে ইজারা প্রথায় ধনী কৃষকরা তাতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। ভূমিসংস্কারের লক্ষ্য হওয়া উচিত
ভূমিহীনদের সমবায়ের মধ্যে এসব হাওর বাওড় ও জলমহল ইজারা দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যখনই যারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন তারা কোন না কোনভাবে ধনী
ও বুর্জোয়া শ্রেণির। ফলে শাসকগোষ্ঠী সর্বদাই নিজেদের সুবিধার্থে নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করে। যার জন্য অদ্যাবধি একটি সুষ্ঠু
ভূমিসংস্কার নীতি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়নি। অধিকন্তু যার প্রভাব সরাসরি কৃষি কাঠামো ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায়
গিয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে ভূমিসংস্কারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত কৃষকের ভূমিহীন প্রক্রিয়াকে বন্ধ করা