বাংলার সমাজের উপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আর্থসামাজিক

বাংলার সমাজের উপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আর্থসামাজিক!
প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, বাংলার সমাজের উপর ব্রিটিশ শাসনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলার সমাজের উপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ফলাফল
তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, ঐশ্বর্য, উন্নত সংস্কৃতি প্রভৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রাচীনকাল থেকে বিদেশি বেনিয়া শক্তিসমূহ এ অঞ্চলের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পোষণ করে। আর তারই ধারাবাহিকতায়্যসর্বশেষ সংযোজন হলো এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ। বস্তুত ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ
ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশ বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী বাংলার সর্বশেষ ও স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে এ উপমহাদেশের যে স্বাধীনতার সূর্য অস্ত মিত করেছিল তা প্রায় ২০০ বছর টিকেছিল। এ সময়ের মধ্যে তারা এ অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক,
রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি দিক থেকে যেমন শাসন ও শোষণ করেছিল তেমনি এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নকেও্ প্রভাবিত করেছিল। এজন্য বলা যায় ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলার সমাজব্যবস্থার উপর ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনের আর্থসামাজিক প্রভাব যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।বাংলার সমাজের উপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আর্থসামাজিক প্রভাব : বাংলার সমাজের উপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আর্থসামাজিক প্রভাব সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার সমাজব্যবস্থার উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। সাধারণত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য জমিদারদের সাথে সম্পাদিত একটি চুক্তি সমতুল্য ব্যবস্থা। ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক এটা ঘোষিত হয়। মূলত এ বন্দোবস্তের ফলে এদেশের সরকার ও বাংলার জনগণ উৎপাদনের বর্ধিত অংশ থেকে বঞ্চিত হয় এবং এ ক্ষতিপূরণের জন্য সরকার সারাদেশে সাধারণ কর বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
২. সিক্ষাব্যবস্থা : বাংলার সমাজব্যবস্থায় প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশরা এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা তথা ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন শুরু করে। ফলে এ শিক্ষাকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নামে একটি নতুন শ্রেণির সৃষ্টি হয়। বস্তুত ঐ শিক্ষা প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রিটিশ শাসনের অনুকূলে কাজ করলেও পরবর্তীতে ঐ
শিক্ষাব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণি ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব পোষণ করতে থাকে এবং জাতীয়তাবাদী তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে তারা অগ্রসর হয়।
৩. কুটির শিল্প ধ্বংস : পূর্ব বাংলার স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম অর্থনীতির অন্যতম উপাদান কুটির শিল্পের উপর ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব ছিল মারাত্মক। কেননা, এতে স্থানীয় কুটির শিল্পের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ব্রিটিশরা এদেশ থেকে শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল সংগ্রহ করে তাদের দেশে নিয়ে বিভিন্ন শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন করে তা পুনরায় এদেশে এনে
বিক্রি করতো। এতে করে কুটির শিল্প থেকে উৎপাদিত দেশীয় পণ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪. সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টি : ব্রিটিশরা ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। আর এ কারণে তারা বিভিন্ন উপায়ে এ উপমহাদেশের জনগণের মধ্যে বিভাজন বা বিরোধ সৃষ্টি করতো। অর্থাৎ এ অঞ্চলে অধিবাসীদেরকে তারা একতাবদ্ধ হতে দিত না। আর এ কারণেই উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে ঐক্য ও সম্প্রীতি গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য তারা বিভিন্ন কলাকৌশলের আশ্রয় নেয়। এভাবে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে মানুষদের মধ্যে সুকৌশলে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বীজ ঢুকিয়ে দেয়।
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে বাংলার সমাজব্যবস্থায় যে কয়টি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রাক ব্রিটিশ বাংলা মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুন্নয়নের কারণেই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সম্প্রদায় ব্যবস্থা গড়ে উঠে। কিন্তু ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশে শাসনভার গ্রহণের পর নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ, রেলপথ, ডাক, তার ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি করে।
৬. নীলচাষ বিদ্রোহ : ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার আর্থসামাজিক ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নীলচাষ ও এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সাধারণত ব্রিটিশরা আর্থিক দিক থেকে লাভবান হওয়ার জন্য বাংলার কৃষক সম্প্রদায়কে নীলচাষে বাধ্য করে। যখন নীলচাষ একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয় তখন নীলকর নামে একশ্রেণির মানুষ বাংলা ও তার
আশপাশের অঞ্চলে কৃষকদের নির্যাতনের মাধ্যমে নীল চাষে নিযুক্ত করে। ফলে এদেশের মানুষ খাদ্য উৎপাদন করতে না পেরে অভাব অনটনে জর্জরিত হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে একদিকে নির্যাতন, অন্যদিকে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন না হওয়ায় বাংলার কৃষক সম্প্রদায় এই নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।
৭. সামাজিক স্তরবিন্যাস পরিবর্তন : ব্রিটিশ শাসনামলের ব্যাপক প্রভাব সমগ্র বাংলার সামাজিক জীবনে লক্ষ্য করা যায়। বাংলায় মানুষের সামাজিক জীবনে এক গতিশীলতার সূচনা হয়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ অনেকাংশে দূরীভূত হয়। তাই বাংলায় যে সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রচলিত ছিল তার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়।
৮. বাংলাকে উপনিবেশে রূপান্তর : ব্রিটিশ শাসনামলে বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে বাংলার অর্থনীতি ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে পরিণত হয়। ইংল্যান্ডের স্বার্থে বাংলার অর্থনীতি, কৃষি তথা সবকিছুকেই ব্যবহার করা হয়। বাংলার বাণিজ্য ইউরোপীয় বণিকদের হাতে চলে যায়। ফলশ্রুতিতে বাংলা একটি পুরো উপনিবেশে পরিণত হয়।
৯. শিল্পায়ন ও নগরায়ণের উপর প্রভাব : ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলায় শিল্পায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল এবং তারা নগরায়ণের ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। তথাপিও একথা
তারাই এ অঞ্চলে উন্নত নগরব্যবস্থার (ঢাকা, কলকাতা, বোম্বে, আহমেদাবাদ নগর) সৃষ্টি ও বিভিন্ন শিল্পকারখানা অনস্বীকার্য যে,
প্রতিষ্ঠা করে। তাদের
১০. সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি বিনষ্ট : ব্রিটিশ শাসনামলে কেবলমাত্র বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের জনগণ • সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়ে প্রচলিত ও উন্নত সংস্কৃতি থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে।
সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি হারাতে থাকে। মুসলমানদের অবস্থা ছিল এক্ষেত্রে মারাত্মক ভয়াবহ। বস্তুত মুসলমানরা তাদের১১. দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রভাব : ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে যুক্তরাজ্যের (ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস) শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শের দ্বারা বাংলা তথা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, উদারনৈতিক ও যুক্তিদর্শন, গণতান্ত্রিক চেতনা প্রভৃতি এ অঞ্চলবাসীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
১২. ভূমি রাজস্বে ব্যাপক পরিবর্তন : ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুতে বাংলার ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । বস্তুত এ পরিবর্তনসমূহ হলো প্রথমত, এদেশে শুল্ক রাজস্বের হার বাড়েনি; দ্বিতীয়ত, জমির বন্দোবস্তের পরিবর্তন; তৃতীয়ত, দেওয়ানি আমলে একসনা ইজারা প্রথার চালু; চতুর্থত, পরবর্তীতে ওয়ারেন হেস্টিং; এ একসনা ইজারা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে পাঁচসনা বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালু এবং পঞ্চমত, লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলার সমাজব্যবস্থার উপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আর্থসামাজিক প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বস্তুত ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে এদেশ কেবল ক্ষতিগ্রস্ত বা শোষিত হয়েছে তাই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমূল ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলায় তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের স্বার্থ চরিতার্থ করা।