অথবা, আমাদের দেশে মৌল মানবিক প্রয়োজনসমূহ যথাযথ পূরণ হচ্ছে কী? এ বিষয়ে তোমার যুক্তি দাও।
অথবা, বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে মৌল মানবিক প্রয়োজন সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে কী? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে প্রতিটি মানব সন্তানের সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য কতকগুলো উপাদান বা উপকরণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। যেসব উপাদান বা উপকরণ ছাড়া ঐ মানব
সন্তানদের বেঁচে থাকা অসম্ভব মৌল মানবিক চাহিদা বলতে সেসব উপাদানের বা উপকরণের প্রয়োজনীয়তাকেই নির্দেশ করা হয়। আর সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই মানুষের মধ্যে তাদের এই মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ করার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।
সেজন্য কখনও তারা পশু শিকার, কখনও কৃষিকাজ, কখনও গুহায় বাস, কখনও আমোদপ্রমোদ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছে।সময়ের বিবর্তনে মানবচিন্তা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের উদ্ভব ও প্রসারের ফলে মানুষ সভ্যতার দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। এ সভ্য সমাজে মানুষের কতকগুলো বিশেষ প্রয়োজনকে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, যা মৌল মানবিক প্রয়োজন বা চাহিদা হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক চাহিদা সন্তোষজনকভাবে পূরণ হচ্ছে কি না :
১. খাদ্য : মৌল মানবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রথম যে চাহিদাটির অবস্থান তা হল খাদ্য। কারণ খাদ্য না হলে পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অথচ আমাদের দেশে খাদ্যজনিত মৌলিক চাহিদাটি যথাযথভাবে কখনই পূরণ করা সম্ভব হয় নি। ১৯৮১ সালে এদেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল মাথাপিছু ০.৩৮ একর, ১৯৮৩-৮৪ সালে তা দাঁড়ায় ০.২৫ একর এবং ১৯৯১ সালে তা ০.১৯ একরে এসে পৌঁছে। আবার দেখা যায়, ১৯৮১ সালে গ্রামের শতকরা
৬৫.৮০ পরিবারের কৃষিজমির মালিকানা ছিল যা ২০০১ সালে এসে নেমে দাঁড়ায় ৫৮.৪৪ ভাগে। প্রতি বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে বর্ধিত জনসংখ্যা এসব কৃষিজমির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। আবাদি জমিতে নতুন নতুন ঘরবাড়ি
উঠছে। ফলে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। দেশের মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ একজন স্বাভাবিক ব্যক্তির যেখানে দৈনিক ৩০০০ কিলোক্যালরি খাদ্য গ্রহণের কথা রয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে জনসাধারণ ২০০০ সাল নাগাদ মাথাপিছু ২২৪০.৩ কিলোক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করছে।
২. বস্ত্র : মানুষের লজ্জা নিবারণ, সূর্যের তাপ ও শীতের ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বস্ত্র তথা পোশাকের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। পোশাক পরিচ্ছদ মানুষের সামাজিকতা, আভিজাত্য রক্ষায় একান্ত অপরিহার্য।আমাদের দেশের গ্রামীণ জনসাধারণ তাদের আয়ের ১০-১২% বস্ত্রের পিছনে খরচ করে থাকে। সরকারি তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে বস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ২২০ কোটি মিটার, অথচ এর চাহিদা প্রায় ৪৪২ কোটি মিটার। ফলে ২২২ কোটি মিটার কাপড়ের ঘাটতি থেকে যায়। ফলে সরকারকে প্রতি বছর একটা মোটা অঙ্কের টাকা এ কাপড় আমদানির পিছনে খরচ করতে হয়।
৩. বাসস্থান : বাসস্থান বলতে গৃহ বা ঘরকে বুঝায়। বাসস্থান মানুষের দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। বাসস্থানের মাধ্যমে মানুষ ঝড়, বৃষ্টি, তাপমাত্রা, শীত, পোকামাকড় হিংস্র প্রাণী ইত্যাদির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। আমাদের দেশে মানসম্মত ও স্বাস্থ্যকর বাসস্থানজনিত চাহিদা পূরণের চিত্র বাস্তবিক অর্থেই করুণ । যেমন- ১৯৯১ সালের আদমশুমারি রিপোর্টে দেখা যায়, দেশে ৫ লাখ ২৫ হাজার লোক গৃহহীন ও ভাসমান অবস্থায় জীবনযাপন করছে। জাতিসংঘ এক জরিপে দেখিয়েছে, এদেশে ১০ লাখ লোকের বাস করার আশ্রয় নেই, ৯৪ লাখ ঘরবাড়ি মাটি ও বাঁশের তৈরি এবং ৪৯ শতাংশ বাড়িতে ময়লা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, জনগণের নিম্ন মাথাপিছু আয়, গৃহ নির্মাণ সামগ্রীর অত্যধিক দাম প্রভৃতি কারণে এদেশে বাসস্থানজনিত চাহিদা অত্যধিক যথার্থভাবে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
৪. শিক্ষা : শিক্ষা হল মানুষের আচরণের এক ধরনের পরিবর্তন, যা সে অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের মাধ্যমে লাভ করে। শিক্ষা মানুষকে শিক্ষিত করে তোলে। ফলে ব্যক্তি নিজেকে এবং তার পরিবেশ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে শিখে। বাংলাদেশে শিক্ষাজনিত মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ প্রক্রিয়া আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও তা এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উপনীত হয় নি।
৫. চিকিৎসা : চিকিৎসা বলতে স্বাস্থ্যসেবাকে বুঝানো হয়। বিভিন্ন রোগের হাত থেকে প্রতিকার ও প্রতিরোধের প্রত্যাশা প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে।অসুস্থতা ও রুগ্নতা মানুষের স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো তাকে দুর্বল ও অক্ষম করে তোলে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০৪ এ দেখানো হয়েছে, আমাদের দেশে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত ডাক্তার আছে ৩৬,৫৭৬ জন,নার্স ১৯,৫০০ জন, ডিসপেনসারী ও হাসপাতাল শয্যা আছে ৩৪,৬৯৩টি, সরকারি ডিসপেনসারী ১,৩৬২টি এবং থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে ৪০৩টি। আবার হাসপাতালের ১টি শয্যা প্রতি রোগীর সংখ্যা ৪,১০৯ জন এবং প্রতি ৮,৮৭৯ জন লোকের জন্য ১ জন নার্স এবং প্রতি ৩,৮৬৬ জন লোকের জন্য ১ জন রেজিস্টার্ড ডাক্তার রয়েছে। দেশে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ৫৬ জন এবং মাত্র ৪১.২২ ভাগ জনসাধারণ স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করে। সুতরাং এদেশে স্বাস্থ্য তথা চিকিৎসাজনিত চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাপক পরিসরে আরও চিকিৎসা সেবা প্রদান করা জরুরি।
৬. চিত্তবিনোদন : চিত্তবিনোদনের মূলকথা হল Mental refreshment. মানসিক প্রশান্তি আনয়নের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে নতুন প্রাণশক্তির সঞ্চার করার জন্য চিত্তবিনোদনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়, বাংলাদেশে মোট জনসমষ্টির মধ্যে প্রতি হাজারে টিভি সেট রয়েছে মাত্র ৫.৩ জনের। আবার HES এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামের উচ্চশ্রেণীর শতকরা ৫টি পরিবার চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রে মাসিক ১৪.৪০ টাকা খরচ করে যেখানে নিম্নশ্রেণীর ৫টি পরিবারের মাসিক খরচ শতকরা ৭.৩৫ টাকা।
সুতরাং দেখা যায়, চিত্তবিনোদনজনিত মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে অধিকতর দুরবস্থা বিরাজমান। কারণ খাদ্য,বস্ত্রজনিত চাহিদা পূরণ যেখানে যথাযথভাবে সম্ভব নয় সেখানে চিত্তবিনোদনজনিত চাহিদা পূরণ এ করুণ দশাই স্বাভাবিক।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে,বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক প্রয়োজনসমূহ সন্তোষজনকভাবে পূরণ হচ্ছে না। কারণ মানুষের যেসব মৌলিক মানবিক চাহিদা রয়েছে তার কোনটিই এদেশে কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনে সক্ষম হয় নি। এর জন্য দায়ী জনসংখ্যাস্ফীতি, দরিদ্রতা, বেকারত্ব, দীর্ঘ সময়ের বৈদেশিক শাসন ও শোষণ,রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সর্বোপরি একটি সুষ্ঠু সরকারি নীতিমালার অভাব। তাই বলা যায়, দেশে মৌলিক মানবিক চাহিদাসমূহ সন্তোষজনকভাবে পূরণ করার জন্য সরকারি কর্মসূচি ঢেলে সাজানো এবং পাশাপাশি এনজিওগুলো এবং স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করে নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন করা যেতে পারে।