অথবা, বাঙালি দর্শনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা কী?
অথবা, বাঙালি দর্শনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরুত্ব কী?
অথবা, বাঙালি দর্শনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাৎপর্য কী?
অথবা, বাঙালি দর্শনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : সমাজের উচ্চাসনে আসীন হয়েও যিনি অবহেলিত, উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভেবেছেন, যার জন্ম বাঙালি জাতির গর্ব, যাকে আকাশের সাথে তুলনা করা হয়, যাঁর বিস্তৃতি বিশ্বজোড়া, তিনিই হলেন বাঙালি দর্শনের অগ্রসৈনিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ দার্শনিকদের মতো চিন্তা করেননি, অথচ তাঁর চিন্তা
যুক্তিহীন নয়। তাঁর মধ্যে এমন একটা সূক্ষ্ম বোধশক্তি ছিল, যা তাঁর সকল কল্পনার মধ্যে মনস্বিতা সঞ্চার করেছে। অন্ধ আবেগের বদলে যুক্তিসিদ্ধ কল্পনাকে তিনি তাঁর সমগ্র সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন দার্শনিক কবি। নিম্নে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন চিন্তাধারা বর্ণনা করা হলো :
১. রবীন্দ্রনাথের বেদান্ত দর্শন : বেদের সর্বশেষ অংশ বলে উপনিষদের অপর নাম বেদান্ত দর্শন। রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্ম জীবন ও জগতের বহুত্বের মধ্যে নিজেকে বিকশিত করে নিখিলের আনন্দযজ্ঞে অংশ নিয়েছেন। ধর্মবোধ সম্পর্কে তাঁর উক্তি লক্ষণীয়, পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার প্রেমাস্বাদনের পরিপূর্ণ প্রেমের সম্বন্ধ উপলব্ধিই ধর্মবোধ। জীবের জন্যই তিনি দ্বৈতভাব গ্রহণ করেন ।
২. রবীন্দ্রনাথের রহস্যবাদ : সকল শ্রেষ্ঠ দার্শনিকই রহস্যবাদ বা এ রহস্যময় পৃথিবীর আত্মজিজ্ঞাসা তাঁদের পার্থিব তন্ময়তার বাণীর মাধ্যমে আমাদের নিকট বিবৃত করেছেন । রবীন্দ্রনাথ জীবন প্রভাতেই জানতে পেরেছেন
সংকীর্ণতার মায়ামোহ কারাগার প্রকাণ্ড আকার হয়ে তাঁকে চারদিকে বেষ্টন করেছে।
৩. রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ : বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি যাঁদের কণ্ঠে মানবতার জয়গান শোনা যায় তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়েও তিনি অবহেলিত, উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা
ভেবেছেন। কবির অকৃত্রিম সহানুভূতি ও সহমর্মিতা তাঁর অসংখ্য কবিতা ও গানে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেছেন, “মূক যারা দুঃখে সুখে নতশির যারা বিশ্বের সম্মুখে
ওগো গুণী কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি।”
৪. রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। বাঙালির আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রতীচ্যের শিক্ষাদর্শনকে পুরোপুরি খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয় বলে প্রাচ্যের অনেক দার্শনিকই প্রতীচ্যের শিক্ষাদর্শনকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন। এদের মধ্যে অন্যতম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ
প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনকে প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন বলা হয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
৫. রবীন্দ্রনাথ ও প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন : প্রকৃতিবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো স্বভাবগত বিকাশকে সাহায্য করা। আর এ বিকাশ হবে প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতি অনুযায়ী। এটিই প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শনের মূল বক্তব্য।
প্রকৃতিবাদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিবাদী। আবার ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণে ও শিক্ষার প্রকৃতি নির্ধারণেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতিবাদী। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, জীবনের শুরুতে বিকৃতির সমস্ত কৃত্রিম কারণ থেকে স্বভাবকে প্রকৃতিস্থ রাখা খুব দরকার। এ অবস্থা শিশুদের জন্য সুখের অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ শহরের শিক্ষাকে অস্বীকার
করেন । তিনি বলেছেন, কাজের ঘূর্ণির মধ্যে ঘাড়মুড় ভেঙে পড়ার আগে শিখবার সময়, বেড়ে উঠার সময় প্রকৃতির সহায়তা একান্তভাবে প্রয়োজন । অগ্নি, জলবায়ু, স্থলকে মনের দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেখতে
শেখাই প্রকৃত শেখা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাঙালি দর্শনের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ যে অবদান রেখেছেন তা এদেশের প্রতিটি মানুষকে যুগ যুগ ধরে অনুপ্রাণিত করবে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন বর্তমান বিশ্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-বেদনা নিয়ে কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস রচনা করেছেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বার প্রান্তে এসে আজ আমরা সত্যিই উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছি যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন সার্থক মানবতার পূজারী বাঙালি দার্শনিক।