পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামোর মূলনীতিগুলো আলোচনা কর।

অথবা, তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামোর মূলনীতিগুলো সংবিধান অনুযায়ী
বর্ণনা কর।
অথবা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন ও শাসনতান্ত্রিক কাঠামো আলোচনা কর।
অথবা, শাসনতান্ত্রিক কাঠামো উল্লেখপূর্বক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : যেকোনো দেশের শাসনব্যবস্থার মূলনীতিগুলো দ্বারা পরিচালিত হয়। একটি রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিধি মূলনীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় মূলনীতির মাধ্যমে। পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কতিপয় মৌলিক মূলনীতি বাস্তবায়িত হয়। যা
কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থাকে অনেকাংশে বাস্তবায়িত করে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামোর মূলনীতি : নিচে পাকিস্তান শাসনামলে কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামোর মূলনীতিগুলো আলোচনা করা হলো :
১. ফেডারেল আইনসভা : পাকিস্তানে একটি ফেডারেল আইনসভা থাকবে। ফেডারেল আইনসভা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট হবে। উচ্চ কক্ষের নাম ‘হাউস অব ইউনিটস’ এবং নিম্নকক্ষের নাম ‘হাউস অব পিপলস’। উচ্চ কক্ষ পাকিস্তানের দুঅংশের সমান প্রতিনিধি থাকবে। নিম্ন কক্ষের সদস্যবর্গ জনগণের ভোটে সংসদীয় এলাকা ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ভোটে প্রদেশভিত্তিক উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচিত হবেন।
২. গণপরিষদের কাজ : গণ পরিষদের কার্যক্রমে তাদের উপস্থিতির হার ছিল নগণ্য। প্রথম গণপরিষদের সাত বছরব্যাপী মেয়াদকাল ১৬টি অধিবেশন নুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় পরিষদের মুসলিম লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আলাপ আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন পাস হতো।
৩. রাষ্ট্রপতি : পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন। তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। তিনি পার্লামেন্টের সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ হবে দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে ৫ বছর পর্যন্ত। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হবার
৩০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে হবে। রাষ্ট্রদ্রোহিতা কিংবা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করার আইন ছিল সংবিধানে।
৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা : সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রদত্ত হয়। রাষ্ট্রপতি আইনসভার সংখ্যগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন কিন্তু গভর্নর জেনারেল কারও পরামর্শ না নিয়েই তার সহকারী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতেন। রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিবৃন্দ, মহা হিসাবরক্ষক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রমুখকে নিয়োগ
প্রদান করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। তিনি বৈদেশিক রাষ্ট্রদূতদের পরিচয়পত্র গ্রহণ করবেন।
৫. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভা : পাকিস্তানের একটি এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকবে। পার্লামেন্টের সদস্যরা
প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। পার্লামেন্টের অধিবেশন পর্যায়ক্রমে ফেডারেল রাজধানী এবং পূর্বাঞ্চলের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হবে। পার্লামেন্টের মেয়াদ হবে চার বছর। পার্লামেন্টের সদস্যরা লাভজনক কোনো পদে আসীন হতে পারতেন না। দুই অধিবেশনের মাঝে ছয় মাসের অধিক সময় ব্যবধান হবে না। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের তিন মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের অধিবেশন বসবে। রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করবেন।
৬. মন্ত্রিপরিষদ : কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের মন্ত্রিগণ ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে তাদের কার্যাবলির জন্য পার্লামেন্টের নিকট দায়ী থাকবেন। পার্লামেন্টের সকল সদস্য মন্ত্রী হবার যোগ্য হবেন। পার্লামেন্টের সদস্য নন এমন কাউকে মন্ত্রী নিয়োগ করলে তাকে ছয় মাসের মধ্যে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে হবে।
৭. আইন সংশোধন : সংবিধানের যেকোনো সংশোধন পার্লামেন্টের দুই-তৃতীংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সংশোধন করা যাবে। কিন্তু কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সম্পর্কজনিত বিষয়াদি সংশোধন করতে হলে তা প্রথমে সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক আইন পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাস করতে হবে। তারপর কেন্দ্রীয় পরিষদের দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গৃহীত হতে হবে। মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেমন-
ক. আইনের চোখে সকলে সমান,
খ. আইন আদালতে বিচার ব্যতীত কাউকে আটকে রাখা যাবে না।
গ. ভোটাধিকারপ্রাপ্তির ন্যূনতম বয়স হবে ১৮ এবং আইন পরিষদের সদস্যদের বয়স হবে ন্যূনতম ২১ বছর।
ঘ. হেবিয়াস কর্পাস রদ করতে কোনো বিধান থাকবে না।
৮. ইউনিট প্রধান : পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রত্যেক ইউেিনটে একজন করে ইউনিট প্রধান থাকবে । ইউনিট প্রধান
রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। রাষ্ট্রপ্রতির ইচ্ছামতো সময় পর্যন্ত তিনি ইউনিট প্রধান হিসেবে থাকবেন। তবে ইউনিট প্রধানের
কার্যকালের মেয়াদ একাধিকক্রমে পাঁচ বছরের বেশি হবে না। ইউনিট প্রধান ৫ বছরের জন্য একজন মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ করবেন।
তিনি ইউনিট আইনসভার সদস্য হবেন। ইউনিট প্রধান মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য মন্ত্রী উপমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। যারা
মন্ত্রী হবেন তাদের ইউনিট আইন পরিষদের সদস্য হতে হবে কিংবা ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচিত হতে হবে।
৯. স্বাধীন নির্বাচন কমিশন : পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন থাকবে। স্বাভাবিক অবস্থায় পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচন করার বিধান করা হয়। জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রণয়ন, প্রতিবছর এসব
তালিকা সংশোধন ও আইনসভাসমূহের নির্বাচন পরিচালনা করা নির্বাচন কমিশনের কাজ ছিল ।
১০. দুই কক্ষের ক্ষমতা ও সম্পর্ক : ফেডারেল আইনসভার নিম্নকক্ষের হাতে সকল ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। মন্ত্রিসভা যৌথভাবে নিম্নকক্ষের নিকট দায়ী থাকবে। দুকক্ষের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হলে উভয় কক্ষের অধিবেশন বসবে এবং সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
১১. বিচার বিভাগ : পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামোর মূল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটি সুপ্রিম কোর্ট থাকবে। বিচার বিভাগকে সংবিধানের রক্ষাকর্তা ও ব্যাখ্যাদাতার ক্ষমতা দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে প্রদেশগুলোর মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার খতিয়ান সুপ্রিম কোর্টের উপর অর্পিত হয় ।
১২. ফেডারেল এবং ইউনিটের সম্পর্ক : পাকিস্তানে ফেডারেল এবং ইউনিটের মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। যেমন-
ক. ফেডারেল আইনসভার জন্য নির্দিষ্ট তালিকা,
খ. ইউনিট আইসভার জন্য নির্দিষ্ট তালিকা এবং
গ. আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে এমন বিষয়ের তালিকা উল্লিখিত তিন তালিকা বহির্ভূত ফেডারেল আইনসভার এক্তিয়ারভুক্ত হবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পরিচালনার জন্য মূলনীতিগুলো ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী। কিন্তু পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের অভূতপূর্ব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কারণে মূলনীতিগুলো সুচারুভাবে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। এর ফলে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হতে পারেনি।