অথবা, পাকিস্তানের শাসনামলে পূর্ব বাংলার প্রতি অর্থনৈতিক শোষণের দিকগুলো আলোচনা কর।
অথবা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিবরণ দাও।
অথবা, পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে লিখ।
উত্তরা৷ ভূমিকা : পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনালগ্ন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ভাবতে শুরু করে এবং ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ শুরু করে। পূর্ব বাংলার জনগণ রাজস্ব আয়-ব্যয়, মূলধন গঠন ও বিনিয়োগ উন্নয়ন বাবদ ও উন্নয়ন প্রকল্প বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য বণ্টন ও আমদানি রপ্তানি প্রভৃতি ক্ষেত্রে শোষণের শিকার হতে থাকে৷ পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক এরূপ শোষণমূলক নীতি অনুসরণের ফলে ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে শুরু হয় বাঙালির মুক্তি যুদ্ধে সৃষ্টি হয় নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রবাংলাদেশ।
পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব বাংলার প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্যের : পাকিস্তান রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকার ছিল সর্বক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। ফলে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সম্পদ বিভাজনে কেন্দ্রীয় সরকার একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতো। এর ফলে পূর্ব বাংলার ন্যায্য অধিকার ও সমানুপাতিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বৈষম্য পরিলক্ষিত
হতো। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য : পাকিস্তান রাষ্ট্র শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলাকে শোষণ করতে থাকে। ১৯৪৮-১৯৫৩ সময়সীমায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে পূর্ব বাংলা দ্রব্য আমদানি খাতে ৯০ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা ঋণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৯৫৩-১৯৫৪ (৯ মাস) সময়সীমায় পূর্ব বাংলার উপর থেকে বাণিজ্য খাতে ১৬ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা আদায় করে। নিচে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে বৈষম্যের কিছু উদাহরণ প্রদান করা হলো :
ক. ১৯৪৮-১৯৫০ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ৮৮ কোটি রুপি ও পূর্ব বাংলার জন্য ২৫ কোটি রুপি। ১৯৫০-১৯৫৫ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১,১২৯ কোটি রুপি ও পূর্ব বাংলার জন্য ৫২৪ কোটি রুপি। ১৯৫৫-৬০ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১,৬৫৫ কোটি রুপি ও পূর্ব বাংলার জন্য ৫২৪ কোটি রুপি ।
ঘ. ১৯৬০-১৯৬৫ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ৩,৩৫৫ কোটি রুপি এবং পূর্ব বাংলার প্রতি ১.৪০৪ কোটি রুপি।
খ. ১৯৬৫-১৯৭০ সালের জন্য, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ৫,১৯৫ কোটি রুপি এবং গ. পূর্ব বাংলার জন্য ১,১৪১ কোটি রুপি বরাদ্দ করে।
২. আঞ্চলিক বিনিয়োগ বৈষম্য : ১৯৫০ এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট বিনিয়োগের ২১% থেকে ২৬%। ১৯৬০ এর দশকে তা বৃদ্ধি পেয়ে, ৩২% থেকে ৩৬%। অন্যদিকে রাজস্ব ও
উন্নয়ন খাত মিলে পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ করা হয়। প্রথম দশকে ৭৪% থেকে ৭৯% এবং দ্বিতীয় দশকে ৬৪% থেকে ৬৮% । প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সর্বমোট ১১৬০ কোটি টাকার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল মাত্র ২৮%।
৩. শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈষম্য : পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৯-১৯৫০ সালে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের হার ছিল মোট উৎপাদনের ৯.৪% এবং ১৯৬৯-৭০ সালে তা উন্নীত হয় ২০% এ। অপরপক্ষে পশ্চিম-পাকিস্তানে শিল্পায়িত খাত ১৯৪৯-৷ ১৯৫০ সালে ১৪.৭% থাকলেও ১৯৬৯-১৯৭০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ।
৪. জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য : পাকিস্তানে দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণের ফলে জীবনমাত্রার মানে চরম বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। ১৯৪৭ সালের দিকে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় ২৫ টাকা বেশি ছিল। দু বছর পর সে ব্যবধান সৃষ্টি হয় ৬৩ টাকায়। ১৯৬৯-৭০ সালে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ৩৩১ টাকা অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৫৩৩ টাকা।
৫. অর্থনৈতিক অবকাঠামো খাতে বৈষম্য : পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যায় ৪৬% বসবাস করতো পশ্চিম পাকিস্তানে অথচ জাতীয় সম্পদের ৭৫% বরাদ্দ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। বরাদ্দ অর্থ বরাদ্দ বেশি হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানে জীবনমাত্রার মান ও কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধি পায়। উচ্চপদস্থ সামরিক, বেসামরিক আমলাদের বাসস্থান, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা, ব্যাংক, বিমা, বিদেশি দূতাবাস প্রভৃতি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত হওয়ায় অর্থনৈতিক অবকাঠামো সুদৃঢ় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনেতিক বৈষম্য প্রকট হয়। এছাড়া উদ্বুদ্ধ অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে জমা থাকতো, পূর্ব
বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তেমন কোনো মূলধন ছিল না।
৬. সম্পদ পাচার : পূর্ব-পাকিস্তান ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব-পাকিস্তান হতে অনেক মূলধন ও দ্রব্যসামগ্রী পাচার করে নিয়ে যেত। এক হিসাবে দেখা যায় যে, প্রতিবছর প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন রুপি পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতো। ১৯৪৮-১৯৪৯ থেকে ১৯৬৮-১৯৬৯ পর্যন্ত বিশ বছরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ১৯ শতাংশ সম্পদ পাচার করা হয়।
৭. বৈদেশিক সাহায্য ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য : পশ্চিম পাকিস্তানিরা বৈদেশিক সাহায্যের সিংহভাগ ভোগ করতো। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান ৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ঋণ ও মঞ্জুরি পায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে প্রদত্ত
৭.৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অর্থনৈতিক সাহায্যের ২.০২ বিলিয়ন ডলার পায় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭ – ৭০ এর মধ্যে প্রদত্ত
তহবিলের প্রায় ৬.৪ বিলিয়ন ডলার কাজে লাগানো হয়। তা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কাজে লাগানো হয় ১.৯ বিলিয়ন ডলার।
৮. বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বৈষম্য : পাকিস্তানের জন্মলগ্ন হতেই দু’অঞ্চলের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। পাকিস্তান জন্মের পর ৮টি মুসলিম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭টিই ছিল করাচিকেন্দ্রিক। ১৯৪৭-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছে ৮২৩৮ মিলিয়ন টাকার পণ্য। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়েছে ৮২৩৮ মিলিয়ন টাকার পণ্য।
৯. মুনাফা ও মূলধন আহরণের মাধ্যমে শোষণ : মূলধন আহরণের ক্ষেত্রেও পূর্বাঞ্চলের লোকজন শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধান প্রধান ব্যাংক, বিমা, পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের অধিকার বজায় থাকতো। পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিরা সহজে ঋণ পেত শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের ৩৬টি তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল ১৫টি। এসব ব্যাংকের মধ্যে ১০ টি পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকানাধীন ছিল, সেখানে ৭৫% মূলধন জমা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের কোন বিনিয়োগকারীর, তবে তারা ১০% মূলধন দেখিয়ে ৯০% ঋণ নিয়ে
শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে পারতো। পূর্ব পাকিস্তানের বিনিয়োগকারীরা এ রকম সুযোগ সুবিধা পেত না।
১০. রাজস্ব আয় ও ব্যয়ে বৈষম্য : ১৯৬৫-১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের মোট রাজস্বের ৬৪৮০ মিলিয়ন টাকা ব্যয় করা হয় একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ২২২৩০ মিলিয়ন টাকা। এছাড়া ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে যে ব্যয় হয় তার একটা অংশ পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপানো হয়।
১১. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে বৈষম্য করা হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি। ১৯৫৫-৫৬ থেকে ১৯৫৯-৬০ সাল পর্যন্ত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মোট ৩০০২০ লক্ষ রুপি বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত ব্যয় হয়েছিল ১১৩ কোটি ৩ লক্ষ ৮০ হাজার রুপি । অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যয় ছিল ৫০০ কোটি রুপি।
১২. দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈষম্য: ১৯৬০-৬১ থেকে ১৯৬৪-৬৫ সাল ছিল দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী সময় কাল। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যয় ছিল ৯৫০ কোটি আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ছিল ১৩৫০ কোটি রুপি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দীর্ঘ ২৪ বছরে অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকে পরিণত হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি ও সম্পদ পাচার করে পশ্চিম পাকিস্তান আধুনিক শিল্প নগরীতে পরিণত হয়। অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হতো। এরূপ বৈষম্যের ফলে পূর্ব পাকিস্তানি জনগণ অধিকার আদায়ে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী হয়ে উঠে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার ও প্রেরণার উৎস।