সমৰ্থনমূলক সমস্যা সমাধানের কৌশলসমূহ কী কী?

অথবা, সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় সমর্থনমূলক সমস্যা সমাধানের কৌশলসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, সমর্থনমূলক পদ্ধতির কৌশলগুলো লিখ।
অথবা, সমর্থনমূলক পদ্ধতির কৌশলগুলো উল্লেখ কর।
অথবা, সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার কী কী কৌশল রয়েছে?
অথবা, সমাজকর্মে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যেসব কৌশল অনুসরণ করা সেগুলো লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমর্থনমূলক সমস্যা সমাধান পদ্ধতি বলতে ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের এমন ধরনের পদ্ধতিকে নির্দেশ করে যে পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে সমর্থন প্রদান করা হয়ে থাকে। ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায়
সমর্থনমূলক পদ্ধতিই বেশি ব্যবহৃত হয়।
সমর্থনমূলক সমস্যা সমাধানের কৌশলসমূহ : সমর্থনমূলক পদ্ধতির কতকগুলো কৌশল রয়েছে। যথা :
১. পুনঃনিশ্চয়তা (Reassurance) : সাহায্যার্থীর সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতা জোরদার করার লক্ষ্যে পুনঃনিশ্চয়তা কৌশল ব্যবহৃত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. আবদুল হাকিম স (২০০০: ১৩৪) বলেছেন, “তার (ব্যক্তির) সামর্থ্য, কৃতিত্ব, চাহিদা ও অনুভূতির প্রকাশ্য স্বীকৃতি তার ক্ষেত্রে অনুমোদন যোগায়। সাহায্যার্থীর প্রতিক্রিয়া যখন প্রাসঙ্গিক
ও গ্রহণযোগ্য ও অভ্রান্ত বলে মনে হচ্ছে অথচ সে তার সামর্থ্য ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না, মনে মনে শুধু সন্দেহই করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় উক্ত পুনঃনিশ্চয়তাসূচক কৌশল গতিশীল উপাদান হিসেবে ব্যক্তিকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা দান করে।”
২. সহায়ক তথ্য প্রদান (Supporting information) : সমস্যা সম্পর্কে সাহায্যার্থীর জ্ঞানের অভাব বা জ্ঞানের স্বল্পতা থাকতে পারে সমাজকর্মীকে এ কারণে সাহায্যার্থীর প্রকৃত সমস্যা কি তা জানাতে হয়। তাছাড়া সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কেও সাহায্যার্থীকে তথ্য প্রদান করা হয়। এতে ব্যক্তি যখন তার সমস্যা ও তা সমাধানের উপায় সম্পর্কে অবহিত হন তখন সে নিজেই সমস্যার বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করে।
৩. যুক্তিপূর্ণ আলোচনা (Logical conversation) : সাহায্যার্থীর সাথে সমাজকর্মীর যুক্তিপূর্ণ আলোচনা সাহায্যার্থীকে সমস্যার বাস্তবতা উপলব্ধি, প্রত্যক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে কার্যকরভাবে সাহায্য করে। যুক্তিপূর্ণ আলোচনা
ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তাকে সক্রিয় করে, ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলে, মনোচঞ্চলতাকে ফিরিয়ে আনে এবং যথাবিহিত কর্ম নির্ধারণ করতে সক্ষমতা দান করে। ব্যক্তির বোধশক্তি উদয় হয় এবং সে দায়িত্ব সচেতন হয়।
৪. প্রদর্শনমূলক আচরণ (Demonstrative behaviour) : সাহায্যার্থীর সকল প্রকার অনুভূতি বা উদ্দীপনাই প্রদর্শনমূলক আচরণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার চাহিদা নিরূপণ ও সমস্যা নির্ণয় করতে সক্ষম হয় এবং সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সে অগ্রসর হতে চায়। কিন্তু সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি কার্যকর উপায় জানে না অথবা তা নির্ণয় করতে পারে না। এমতাবস্থায় ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের জন্য প্রদর্শনমূলক আচরণ কৌশল প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
৫. উপদেশ ও পরিচালনা (Advice and guidance) : সমস্যা সমাধানে গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে ব্যক্তি কোন কোন সময় বাধাগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী ব্যক্তিকে উপদেশ ও নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন। ব্যক্তির মধ্যে যখন সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে প্রজ্ঞাবান হয় এবং সমস্যা সমাধানে তার ভিতরে প্রেষণা কাজ করে অথচ সমস্যা সমাধানে অসমর্থ হয় তখন তার প্রয়োজন পড়ে সমাজকর্মীর নির্দেশনার। এ নির্দেশনা ব্যক্তিকে তার সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।
৬. বাস্তব সীমা নির্ধারণ (Setting realistic limits) : ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার অক্ষমতা, বাস্তব বিবর্জিত কর্মকাণ্ড কিংবা তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি কিংবা তার আচরণের একটা সীমারেখা টেনে দেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীকে মোটামুটি তিনটি কাজ করতে হবে। যথা :
ক. ব্যক্তির ‘অহম’ বোধে শক্তির যোগান দিতে হবে,
খ. ব্যক্তির কাছ থেকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য আচরণের ইঙ্গিত পেলে সেই আচরণ প্রদর্শনে ইন্ধন যোগাতে হবে এবং
গ. অগ্রহণযোগ্য, অশালীন ও ক্ষতিকর আচরণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে হবে।
৭. প্রকাশ্য আলোচনা (Open discussion) : ব্যক্তি যখন ভাবাবেগ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হয় তখন তার সাথে প্রকাশ্য আলোচনা ফলদায়ক হয়। যখন ব্যক্তিকে ভাবাবেগ মুক্ত করা সম্ভব হয় তখন ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়। যন্ত্রণাদায়ক এবং অপ্রকাশিত আবেগের প্রকাশ, সেবাগ্রহীতার সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতাকে অধিকতর কার্যোপযোগী করার সহায়ক। এ কৌশল প্রয়োগ করে সেবাগ্রহীতার যে কোনো ধরনের যন্ত্রণাদায়ক আবেগ প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। একে emotional catharsis অর্থাৎ নেতিবাচক আবেগের অবমুক্তি বলা হয়।
৮. প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ (Direct intervention) : অনেক সময় ব্যক্তির আচরণের সীমা লঙ্ঘিত হয়, ব্যক্তি বেপরোয়া হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি অযাচিত, বেপরোয়া ও অপ্রাসঙ্গিক যাতনা নিরসনের ব্যাপারে সমাজকর্মীকে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করতে হয়। ফলে ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা পালন সংক্রান্ত অক্ষমতা দূর হয় এবং ব্যক্তি ক্রমশ সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে শক্তি অর্জন করার ক্ষেত্রে শক্তি সঞ্চার করে।
৯. অভ্যাসগত আচরণ প্রকৃতির ব্যবহার (Use of habitual pattern) : ব্যক্তি সমাজকর্ম নির্দিষ্ট এবং প্রতিষ্ঠিত কতকগুলো আচার আচরণ বা প্রতিক্রিয়ার ধরন। অধিক হারে কাজে লাগানোর মাধ্যমে, সেবাগ্রহীতার ভূমিকা পালন ক্ষমতা জোরদার করার জন্য এ কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। অভ্যাসগত আচার আচরণকে গঠনমূলক উপায়ে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনে সেবাগ্রহীতার বাহ্যিক আচার-আচরণের ধরন সংশোধনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। এতে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গঠনমূলক পরিবর্তন সূচিত হয়।
১০. আত্মসচেতন প্রক্রিয়া (Self-confrontation) : ড. আবদুল হাকিম সরকার (২০০০ : ১৩৭) এর ভাষায়,
“পারিবারিক, সামাজিক পরিবেশে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাহায্যার্থীর সম্পর্ক এবং নিজের সম্পর্কে তার মধ্যে স্বচ্ছ উপলব্ধি সৃষ্টি ও জোরদার করার লক্ষ্যে মোকাবিলাকরণ কৌশল প্রয়োগ করা হয়। এ ধরনের আত্মমোকাবিলার ব্যবস্থা বা সচেতনতা ব্যক্তির পক্ষে তার নিজ সম্পর্কে নতুন করে হলেও বুঝার অবকাশ সৃষ্টি করে। ফলে ব্যক্তি তার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য অর্জনে সুবিধাজনক উপায় খুঁজে পেতে সক্ষম হয়।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সমাজকমিগণকে উপর্যুক্ত কৌশলগুলো অবলম্বন করতে হয়। এগুলো হলো সমর্থনমূলক পদ্ধতির কৌশল। তবে ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে শুধু সমর্থনমূলক কৌশলই যথেষ্ট নয়, অনেক সময় সংশোধনমূলক কৌশলও প্রয়োগ করতে হয়।সমর্থনমূলক কৌশলগুলো ব্যক্তিভেদে ও সমস্যাভেদে আলাদাভাবে প্রয়োগ করা হয়। তবে অনেক সময় কৌশলগুলোর সমন্বিত প্রয়োগ করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে সাহায্যার্থী ব্যক্তির সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মীকে সাহায্যার্থীর সমস্যার আলোকেই এক বা একাধিক কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়।