অথবা, ১৯৪৭ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যগুলো তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর অবজ্ঞা ও অপমানসূচক আচরণ শুরু করে। সামাজিক ও সংস্কৃতির প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করার পিছনে কারণ হচ্ছে বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে বাঙালিদের আত্মপরিচয় মুছে ফেলা। ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব বাংলার জনগণ যেসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার হয় তা নিচে দেওয়া হলো :
সামাজিক বৈষম্য : পাকিস্তান আমলে দুই অঞ্চলের সামাজিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। দুই অঞ্চলের সমাজ জীবনের চিত্র ছিল দুই ধরনের।
উচ্চবিত্ত শ্রেণির অবস্থান : পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চবিত্তদের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলার উচ্চবিত্তরা জমিদারগোষ্ঠী ছিল হিন্দু এবং তারা কলকাতায় বসবাস করতো। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তারা ভারতে৷ চলে যান এবং তাদের সম্পত্তি ভারতে স্থানান্তর করেন। উপরন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলার রাজনীতি ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থা ছিল। তাই নেতৃত্ব প্রায় সামন্তবাদী
জমিদার শ্রেণির হাতে ছিল, মধ্যবিত্ত শ্রেণির তেমন কোনো নেতৃত্ব ছিল না।
দ্রব্যমূল্যের বৈষম্য : পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের মধ্যে পার্থক্য ছিল আকাশ পাতাল, যা বাঙালির ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের চালের দাম ছিল ১৮ টাকা মণ, পূর্ব পাকিস্তানে মণ ৫০ টাকা, গম পশ্চিম পাকিস্তানে ১০ টাকা, পূর্বে পাকিস্তানে ৩৫ টাকা মণ। ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলায় লবণ সংকট দেখা যায় এবং লবণের দাম ২ টাকা মণ থেকে ১৬ টাকা হয়ে যায়।
সমাজের কল্যাণমূলক কাজে বৈষম্য : রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, অফিস আদালত, হাসপাতাল, ডাকঘর, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, বিদ্যুৎ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালিদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেশি সুবিধা ভোগ করতো। পূর্ব পাকিস্তানে ডাক্তার সংখ্যা ছিল ৭,৬০০, পশ্চিম পাকিস্তানে ডাক্তার সংখ্যার ছিল ১২,৪০০। পূর্ব বাংলার হাসপাতালের বেডের সংখ্যা ছিল ৬,০০০ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের হাসপাতালের বেডের সংখ্যা ২৬,০০০। পল্লি স্বাস্থ্য কেন্দ্র সংখ্যা পূর্ব বাংলায় ৮৮ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৩৮২।
বেকারত্ব সমস্যা : পূর্ব বাংলার সমাজের বেকারত্ব নিরসনে পশ্চিমে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি তার উপর তারা পরিকল্পিতভাবে এ সমস্যা আরো বৃদ্ধি করে। অফিস, আদালত, শিল্পপ্রতিষ্ঠান সবকিছু পশ্চিম পাকিস্ত নেকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। পূর্বের মানুষদের সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে চাকরি করা সম্ভব ছিল না তাই এঅঞ্চলের বেকারত্ব দিন দিন বাড়তে থাকে।
সাংস্কৃতিক বৈষম্য : পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ঐতিহ্য ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৬ শতাংশ এবং এদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ছিল হাজার বছরের পুরানো। কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতির উপর নেমে আসে আমানবিক ও
বৈষম্যমূলক এবং অত্যাচারমূলক আচরণ। পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের ভাষা ও সংস্কৃতি বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তান। সাথে সাথে বাঙালিদের হাজার বছরের পুরানো ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ভাষা মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র শুরু করে। এ প্রক্রিয়া বাঙালির উপর সাংস্কৃতিক নিবর্তন নামে খ্যাত। বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির উপর বৈষম্যের স্বরূপ কেমন ছিল তা নিচে দেওয়া হলো :
বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষার প্রবর্তন পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রথম নির্যাতন শুরু হয় ভাষা পরিবর্তনের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর উর্দুকে পাকিস্তানেররাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দান ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। এ নিয়ে পূর্ব বাংলায় ১৯৪৭ সাল থেকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক,
জব্বারসহ আরো অনেকে ভাষা আন্দোলনে শহিদ হন। ১৯৫৪ সালের ২১ দফার প্রথম দফা ছিল বাংলা ভাষার দাবি, বাংলার
মানুষের আন্দোলনের মুখে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে পাকিস্তান বাধ্য হয়।
১৯৪৯ সালে বর্ণমালা সংস্কারের প্রস্তাব: ১৯৪৯ সালে বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় যে, বাংলা বর্ণমালায় কতিপয় সংস্কৃত বর্ণ রয়েছে যেগুলো ব্যবহার করে। তাই বাংলাকে
সংস্কৃত মুক্ত তথা পবিত্র করার লক্ষ্যে এ ভাষার বর্ণমালার সংস্কারের প্রয়োজন। ভাষা সংস্কারের কমিটি বাংলা বর্ণমালাথেকে ঈ, ঊ, ঋ, ঐ, ঙ, ঞ, ম, ষ, ঢ়, ক্ষ, ৎ, ংঃ বর্ণ বাদ দিয়ে অ্যা বর্ণ যুক্ত করার পরামর্শ দেয়।
রোমান হরফে বাংলা লেখার পদক্ষেপ : পূর্ববর্তী পদক্ষেপ ব্যর্থ হলে আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালে রোমান হরফে বাংলা ও উর্দু লেখার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং একটি কমিটি গঠন করেন। তা ব্যর্থ হয়, ১৯৬৮ সালে পুনরায় রোমান হরফে বাংলা লেখা উদ্যোগ গৃহীত হয়।
প্রকাশনার উপর নিষেধাজ্ঞা : আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালনের অপরাধে সরকার ১৯৬৬ সালে ইত্তেফাকসহ প্রগতিশীল বিভিন্ন প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬৯ সালে শেষের দিকে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন পুস্তক বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং এগুলোর প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
রবীন্দ্র বিদ্বেষী তৎপরতা : বাংলায় অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তোলার পিছনে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে বিধায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগণ প্রথমে ১৯৬২ সালে পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে অবার রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
বাংলার উৎসব নিষিদ্ধকরণ : সর্বপ্রথম সম্রাট আকবর পহেলা বৈশাখ চালু করেন এবং তখন থেকে এ উৎসব বাংলার সকল সম্প্রদায়কে একই বন্ধনে আবদ্ধ করে। কিন্তু আইয়ুব খান ১৯৬৭ সালে পহেলা বৈশাখ পালনকে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব বলে আখ্যা দেন। মূলত আইয়ুব খানের এরূপ ঘোষণা ছিল বাঙালি জাতির শত বছরের সংস্কৃতির মূলে কুঠারঘাত।
শিক্ষা সংকোচন নীতি : ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এ কমিশন তার রিপোর্টে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকার তথ্য প্রদান করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান শিক্ষা সংকোচন নীতি * অনুসরণ করে। ছাত্ররা এ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে পূর্ব বাংলায় ৭৪টি কলেজ এবং ১,৪০০টি উচ্চ বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তান সরকারি মহলে মুখ দিয়ে উদ্ধৃত না হলেও সরকারের এক হীন ষড়যন্ত্র ছিল বাংলা ভাষা সংস্কার ও উর্দু চালুর মাধ্যমে গোটা বাঙালি জাতিকে মূর্খ করে রাখা এবং বাঙালির
জাতীয়তাবাদকে স্তব্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা সুদৃঢ় ও সুদীর্ঘ করা। এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য পাকিস্তান সরকার বাঙালি জাতির উপর সাংস্কৃতিক নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশ্য বাঙালি জাতি সরকারের হীন ষড়যন্ত্রের নিকট কখনো মাথানত করেনি। পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক নিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করে
এমনকি জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি।