উত্তর : ভূমিকা : সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর ১৬০৫ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইতিহাসে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে খ্যাত। ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “তার উদার শিক্ষা, প্রকৃতি প্রদত্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং প্রচুর সাধারণ জ্ঞান তাকে তার পিতার রাজনীতিবিদ সুলভ রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিকে অব্যাহত রাখার জন্য যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন করে তুলে ছিল।” যেসব অভিজাতবর্গ তার সিংহাসনারোহণে বিরোধিতা করেন তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। । পিতার আমলের রাজকর্মচারীদের প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেও জাহাঙ্গীর
ত্রুটি করেন নি। তার আমলে বাংলায় বেশ কয়েকজন শাসক শাসন কার্য পরিচালনা করেন। নিম্নে তাদের শাসন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
→ জাহাঙ্গীরের আমলে বঙ্গদেশের শাসনব্যবস্থা : সর্বশ্রেষ্ঠ মুঘল সম্রাট আকবরের সুযোগ্য পুত্র ও একমাত্র উত্তরাধিকারী
সম্রাট জাহাঙ্গীর দিল্লির মসনদে আরোহণ করে বাংলার স্বাধীন জমিদারগণকে সম্পূর্ণভাবে পদানত করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ও তৎপরতা পরিচালনা করেন। নিম্নলিখিত সুবাদারগণ তার শাসনামলে বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন :
১. রাজা মানসিংহ (১৬০৫-১৬০৬ খ্রি:)
২. কুতুবউদ্দিন কোকা (১৬০৬-১৬০৭ খ্রি:)
৩. জাহাঙ্গীর কুলি খান (১৬০৭-১৬০৮ খ্রি:)
৪. ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রি:)
৫. কাশিম খান (১৬১৩-১৬১৮ খ্রিঃ)
৬. ইব্রাহিম খান (১৬১৮-১৬২২ খ্রি:)
৭. শাহজাদা শাহজাহান (১৬২২-১৬২৫ খ্রি:)
৮. খানজাদ খান (১৬২৫-১৬২৬ খ্রিঃ)
৯. মুকারম খান (১৬২৬-১৬২৭ খ্রি:)
১০. ফিদাই খান (১৬২৭-১৬২৮ খ্রিঃ)
নিম্নে এসব শাসকদের শাসন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. রাজা মানসিংহ : সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েই মানসিংহকে পুনরায় তৃতীয় বারের মত বাংলার শাসনকর্তা
নিযুক্ত করে পাঠান। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই তাকে বিহারের সুবাদার নিযুক্ত করে রোটস দুর্গে প্রেরণ করেন।
২. কুতুবউদ্দিন কোকা : মানসিংহের পর ১৬০৬ সালে কুতুবউদ্দিন কোকা বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তিনি বর্ধমানের ফৌজদার শের আফগানের সাথে সংঘটিত যুদ্ধে ১৬০৭ সালে নিহত হন।
৩. জাহাঙ্গীর কুলি খান : অতঃপর ১৬০৭ সালে জাহাঙ্গীর কুলি খানকে কুতুবউদ্দিন কোকার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করা হয়।
ন্যায়বিচারক ও সাহসী সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলি বাংলাদেশের আবহাওয়া সহ্য করতে না পেরে এক বছর পরেই অর্থাৎ ১৬০৮ সালে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
৪. ইসলাম খান : জাহাঙ্গীর কুলি খানের মৃত্যুর পর ইসলাম খানকে সম্রাট জাহাঙ্গীর সুবাদার নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন যেমনি দুর্ধর্ষ সেনাপতি, ঠিক তেমনি ছিলেন বিচক্ষণ
রাজনীতিবিদ । তিনি ছিলেন ফতেহপুর সিক্রির সাধক পুরুষ শেখ সেলিম চিস্তির দৌহিত্র। তিনি পর্যায়ক্রমে অভিযানের পর
অভিযান পরিচালনা করে বাংলার বার ভূঁইয়া এবং পাঠান সর্দারদের বিপর্যস্ত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য, বীর হাম্মীর, সেলিম খান, শামস খান, ভূষণার রাজা ছত্রজিৎ, পুটিয়ার পীতাম্বর এবং সোনারগাঁওয়ের বীরশ্রেষ্ঠ ভূঁইয়া নেতা মুসা খানকেও তিনি পরাস্ত করে মুঘল
আধিপত্য স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেন। অতঃপর ইসলাম খান ওসমান খানের রাজধানী বোকাইনগর আক্রমণ করে ১৬১১ সালে তা অধিকার করেন। ওসমান খান পলায়ন করে সিলেটে আশ্রয়পূর্বক আবার শক্তি সঞ্চয় করেন। ফলে শ্রীহট্টের অন্তর্গত
দৌলাতাপুরে সংঘটিত আর একটি যুদ্ধে ইসলাম খান ওসমান খানকে পরাজিত ও নিহত করেন। বাংলায় মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তার অসামান্য অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। এ মহান এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুঘল সুবাদার ঢাকার দিয়ে নিকটবর্তী ভাওয়ালে ১৬১৩ সালে মানবলীলা সংবরণ করেন।
৫. কাশিম খান : ইসলাম খানের পর তার ভ্রাতা কাশিম হখান ১৬১৩ সালে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন এ অযোগ্য
শাসক। অপদার্থ শাসক কাশিম খান মগ, পর্তুগিজ এবং শহ আরাকানীদের উপদ্রব হতে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হননি এবং তিনি ১৬১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
৬. ইব্রাহিম খান : ১৬১৮ সালে ইব্রাহিম খান বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভগ্নিপতি। তিনি একজন সুযোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি কৃষি ও
বাণিজ্যের উন্নতি সাধন করে বাংলা ও উড়িষ্যায় শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সমৃদ্ধি আনয়ন করেন। এ সময় তিনি আফগানদেরকে
সম্পুর্ণভাবে পরাজিত করে এবং.অহোমদেরকে বাংলার সীমান্ত হতে বিতাড়িত করে রাজ্যে শান্তি ও নিশ্চিত করেন রাখেন। ইব্রাহিম খান বিদ্রোহী শাহজাদা শাহজাহান কর্তৃক রাজমহলের এক যুদ্ধে নিহত হন।
৭. শাহজাদা শাহজাহান : ১৬২২ ১৬২২ সালে শাহজাদা শাহজাহান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তার সময়ে বাংলায় শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। ১৬২৫ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন।
৮. খানজাদ খান : খানজাদ খান হচ্ছেন মহবৎ খানের পুত্র। তিনি ১৬২৫ সালে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৬২৬ সাল পর্যন্ত তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
৯. মুকারম খান : অতঃপর বাংলার শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন মুকারম খান। তিনি ১৬২৬ সাল থেকে ১৬২৭ সাল পর্যন্ত শাসন কার্য পরিচালনা করেন।
১০. ফিদাই খান : জাহাঙ্গীরের শাসনামলের সর্বশেষ সুবাদার ছিলেন ফিদাই খান। তিনি ১৬২৭ সাল থেকে ১৬২৮ সাল পর্যন্ত শাসন কার্য পরিচালনা করেন। তিনি বাংলাদেশ হতে
প্রচুর অর্থ, হস্তী, অশ্ব ও মসলিন দিল্লিতে প্রেরণ করেন।
উপসংহার : ড. কিরণ রায় চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার দীর্ঘ
বাইশ বছরের রাজত্বকালের মধ্যে ইসলাম খাঁ.ও ইব্রাহিম খার চেষ্টায় বাংলার সর্বত্র মুঘল অধিকার নিরঙ্কুশভাবে স্থাপিত হয়েছিল।”
বাংলাদেশ ভৌগলিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অহোম ও আরাকান রাজ্যের সীমা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।