উত্তর : ভূমিকা ঃ যুবকরা একটি দেশের প্রাণ। যুবশক্তির উন্নয়নই পারে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করতে। বিশ্বের সবদেশেই যুবসমাজের কল্যাণের নিমিত্তে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গৃহীত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে যুবকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। যুবকল্যাণ নিশ্চিতকরণে কর্মসূচিগুলোর যথাযথভাবে বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। তবুও আমাদের দেশে যুব সমাজের অবস্থা তেমন ভালো নয়। শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক এবং নৈতিক দিক দিয়ে যুবকদের সার্বিক কল্যাণ সাধনের নিমিত্তে গৃহীত কর্মসূচিগুলোই মূলত যুবকল্যাণ কর্মসূচি। তাই যুবকল্যাণ কর্মসূচির গুরুত্ব অত্যন্ত ব্যাপক।
সাধারণ অর্থে ঃ সাধারণ অর্থে যুবকল্যাণ বলতে যুবকদের কল্যাণের নিমিত্তে বস্তবসম্মত কর্মসূচির সমষ্টিকে বুঝায় ।
শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও নিরক্ষর যুবকদের যুবকল্যাণের আওতায় আনতে পারলেই সমাজে গঠনমূলক উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
শব্দগত অর্থে ঃ যুবকল্যাণ শব্দগত অর্থে ইংরেজিতে Youth welfare শব্দটিকে নির্দেশ করে থাকে।
→ যুবকল্যাণ ঃ যুবকদের সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা মুক্ত করে ও চাহিদা পূরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যুবকদের দৈহিক, মানসিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক তথা সার্বিক কল্যাণকে বুঝায়। আর এ লক্ষ্যে যুবকদের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও কারিগরী সহায়তা প্রদান করা হয়। যুবকল্যাণের মাধ্যমে তাদের চাহিদা পূরণ হয়, সামগ্রিক বিকাশ
ও উন্নয়ন সাধিত হয়, দেহ-মন ও জীবনীশক্তির কার্যকারিতা আবিষ্কার হয়।
→ প্রমাণ্য সংজ্ঞা ঃ যুবকল্যাণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞায়ন প্রদান করা হলো :
মনীষী Pittman এর ভাষ্যমতে, “যুব উন্নয়ন কার্যক্রম হচ্ছে এমন চলমান প্রক্রিয়া যাতে সকল যুবক তাদের মৌল ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজন পূরণেও কাজের দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনে এবং দৈনন্দিন জীবনে অবদান রাখার লক্ষ্যে নিয়োজিত থাকে।”
ড. আলী সরকার বলেন, “যুবকল্যাণ হচ্ছে যুবকদের জন্য গৃহীত সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী ঐসব যুবসেবা তাদের অবসর সময় ও বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগায়। তাদের শরীর, মন ও আত্মার আবিষ্কার ও বিকাশ সাধন এবং এভাবে তাদেরকে সমাজের পরিপক্ক, সৃজনশীল ও দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে সামঞ্জস্যশীল করার লক্ষ্যে গৃহ
সুবিধা, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।” ভারতীয় সমাজকর্ম বিশ্বকোষ এর সংজ্ঞা মতে, “যুব কল্যাণ প্রথাগত শিক্ষার পরিবর্তে নৈতিক, আর্থিক, শারীরিক বিষয়াদি আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে যুবকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধনকে নির্দেশ করে থাকে।
→ বাংলাদেশ সরকারের যুবকল্যাণ কর্মসূচি ঃ বাংলাদেশ সরকারের যুবকল্যাণ কর্মসূচিগুলোর বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো :
১. জাতীয় যুব সেবা ঃ বাংলাদেশে যুবকল্যাণের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি হলো এই জাতীয় যুব সেবা। যুবকদের যথাযথভাবে সংগঠিত করে এবং নেতৃত্ববোধ জাগ্রত করে তাদের মাঝে শ্রমের প্রতি মর্যাদা বোধ সম্পর্কে সজাগ করা হয়। ফলে সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় পরিবেশ
উন্নয়ন, চিকিৎসা কার্যক্রম, জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক কার্যক্রম, ক্ষুদ্র-কুটির শিল্প প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
২. যুবশিবির স্থাপন ঃ যুবকল্যাণের আওতায় যুবশিবির স্থাপন ব্যবস্থা করা হয়। আর এতে রাস্তা নির্মাণ, খাল খনন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়। যুবকদের মাঝে কর্মোদ্দীপনা, সমাজসেবা ও শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলার জন্যই যুবশিবির সংগঠিত হয়ে থাকে।
৩. যুবউৎসব ও বনভোজন ঃ যুবকল্যাণ কর্মসূচির আওতায় প্রায় যুবউৎসব ও বনভোজনের ব্যবস্থা
করা হয়। যুবউৎসব মূলত যুবকদের জাতীয়ভাবে হস্তশিল্প ও বিভিন্ন খেলাধুলা প্রদর্শন করা হয়। যাতে করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় ঘটে । এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে বনভোজনের আয়োজন করা হয়।
৪. যুব হোস্টেল পরিচালনা ঃ যুবকল্যাণের কর্মসূচিগুলোর অন্যতম একটি যুব হোস্টেল পরিচালনা। দেশের যুবক ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা সফরকালীন থাকা খাওয়া, আরাম-আয়েশ এবং খেলাধুলার সুযোগদানের জন্য ১৯৬২-৬৪ সালের মধ্যে সারাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে মোট ৫টি যুব হোস্টেল নির্মিত হয়েছে। যা যুবকদের বেশ ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক হয়েছে।
৫. জাতীয় যুবনীতি ঃ বাংলাদেশ সরকার যুবকদের কল্যণ দৃঢ়বদ্ধ করতে জাতীয় যুব নীতি প্রণয়ন করেছেন। এটি করা হয় ২০০৩ সালে। এই জাতীয় যুব নীতির আওতায় যুবকদের প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায় বেশ জোরালো সহায়তা প্রদান করা হয়, তাছাড়াও সমাজের যুবকদের সমস্যা, অধিকার ও দায়িত্ব সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সেগুলো যথার্থ বাস্তবায়নের কৌশলও কার্যক্রম নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকে।
৬. যুব দারিদ্র্য নিরসন : বাংলাদেশে হাজার হাজার অর্ধশিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত বেকার যুবক দারিদ্র্যতাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এসব যুবকদের কল্যাণ নিশ্চিতে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হয়ে থাকে।
৭. পরিকল্পনা ঃ যুবকল্যাণের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় পরিকল্পনা গৃহীত হয়ে থাকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা সাধারণত গৃহীত হয়ে থাকে। কিছু পরিকল্পনার নাম নিচে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো- যেমন ঃ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা প্রভৃতি ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়াও বার্ষিক পরিকল্পনা ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যুব উন্নয়ন কার্যক্রম গৃহীত হয়ে থাকে।
৮. সমাজ উন্নয়ন কেন্দ্র ঃ বাংলাদেশের অগণিত শহুরে বসবাসকারী বিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রদেরকে অবসর সময় আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে এ কেন্দ্র চালু করা হয়। এ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচি হচ্ছে ফটোগ্রাফি, রেডিও, টেলিভিশন মেরামত, বিভিন্ন বিষয়ে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা প্রভৃতি পরিচালিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে যুবকল্যাণ বহুগুণে বেড়েই চলেছে।
৯. অশিক্ষিত যুবকদের জন্য জনসংখ্যা কার্যক্রম ঃ অশিক্ষিত যুবকদের জন্য ESCAP ও UNFPA এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালের শেষভাগে এ কার্যক্রম গৃহীত হয়। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে শহর ও গ্রামের বিদ্যালয় বহির্ভূত অশিক্ষিত যুবকদের গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি পালন, কৃষিকাজ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রভৃতি অর্থনৈতিক কাজে এবং খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুবকদের উন্নতি নিশ্চিত করা হচ্ছে।
১০. আর্থসামাজিক কার্যক্রম ঃ যুবকদের উপার্জনশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে কর্মমুখী প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা প্রদানের লক্ষ্য এই যুগান্তকারী কার্যক্রম গৃহীত হয়। আর এ কার্যক্রমের বাস্ত বায়নে যুবদল গঠন করে তাদের মাঝে স্বল্পমেয়াদি ঋণের সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠায় উৎসাহদানে এবং রাস্তাঘাট ও পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ক বিভিন্ন কাজে বেশ সহায়তা প্রদান করা হয়।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যুবকল্যাণ যুবকদের সার্বিক উন্নয়নের নাম। যুবকদের দক্ষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই সমাজের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। তাই যুবকল্যাণের বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়ে থাকে। আর সরকারকে অবশ্যই তা বাস্তবায়নের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।