উত্তর ঃ ভূমিকা ঃ চিকিৎসাক্ষেত্রে হাসপাতাল সমাজকর্মী অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। তার প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে ডাক্তার রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের ব্যবস্থা করেন। মূলত চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ রোগীর সামাজিক দৈহিক চাহিদার মূল্যায়ণের ভিত্তিতে রোগ নির্ণয়ে যে পেশাগত সমাজকর্মী নিয়োগ করেন তাদেরকেই হাসপাতাল সমাজকর্মী বলা হয়। Russell H. Kurtz চিকিৎসা সমাজকর্মীর ভূমিকাকে অট্টালিকা নির্মাণের “স্থপতির” সাথে তুলনা করেছেন।
হাসপাতাল সমাজকর্মী চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনসহ চিকিৎসাকেন্দ্রের অন্যান্য যাবতীয় ব্যবস্থার
উন্নয়নে সর্বদাই নানা ভূমিকা পালন করে। তাই হাসপাতাল সমাজসেবা কর্মসূচিতে তার ভূমিকাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
হাসপাতাল সমাজসেবা ঃ হাসপাতাল সমাজসেবা সমাজের নিম্নশ্রেণির রোগব্যাধি দমনে পরিচালিত এক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। যে কর্মসূচির মাধ্যমে রোগীদের রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে সমাজে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা পর্যন্ত যাবতীয় ব্যবস্থাদি গৃহীত হয় তাকে হাসপাতাল সমাজসেবা বলে ।
সাধারণ অর্থে : যে পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর মনোদৈহিক আর্থ-সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কে জানা যায় ও রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে নিরাময়ের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয় তাকেই মূলত হাসপাতাল সমাজসেবা বলে। এটি আধুনিক
সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
শাব্দিক অর্থে ঃ Social case work method অনুযায়ী হাসপাতাল সমাজসেবা প্রত্যয়টি মূলত হাসপাতাল, চিকিৎসা
ও অসুস্থতার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত বিষয়। আর Hospital Social science-এর বাংলা অর্থ হিসেবে হাসপাতাল সমাজসেবা কথাটির উদ্ভব হয়েছে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা :
Skidmore এবং Thackery বলেন যে, “হাসপাতালে সমাজসেবা সমাজকর্মের মূল্যবিধি, জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলিত এক প্রচেষ্টা।” অন্যদিকে সমাজকর্ম অভিধান অনুযায়ী, “হাসপাতাল সমাজসেবা পরিচালিত হয় যেকোনো মানুষের স্বাস্থ্যগত ব্যাধি
নির্ণয়ে বিভিন্ন বিষয়াদি গভীরভাবে পর্যালোচনা ও প্রয়োগ প্রচেষ্টার মাধ্যমে যা সাধারণত গরিব-দুঃখী, মানুষের স্বার্থের
সাথে সম্পর্কযুক্ত।” Richard c. cobut এর ভাষায়, “সমাজকর্মীর প্রচেষ্টায় দুঃস্থ-দুঃখী রোগীদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে
সংগঠিত কর্মসূচির নাম হাসপাতাল সমাজসেবা।”
→ হাসপাতাল সমাজকর্মীর ভূমিকা ঃ বাংলাদেশের হাসপাতাল সমাজকর্মী দরিদ্র-অসহায় রোগীদের সুস্থ ও সুন্দর
জীবন ফিরিয়ে দিতে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করে। তাদের ভূমিকা নিম্নরূপঃ
১. হাসপাতালে রোগী ভর্তি করানো ঃ হাসপাতালে রোগী ভর্তি করানো হাসপাতাল সমাজকর্মীর প্রধান কাজ। বিভিন্ন
অঞ্চলের আগত রোগীরা হাসপাতাল সম্পর্কে খুব কমই জানে। তিনি তাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে সার্বিকভাবে সাহায্য করে থাকে। 1
২. হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের সাথে রোগীর সম্পর্ক তৈরি ঃ হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, আয়া প্রভৃতি সংশ্লিষ্টদের সাথে রোগীর দেখা-সাক্ষাৎ ও সম্পর্ক তৈরিতে হাসপাতালে সমাজকর্মী মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে ।
৩. তথ্য উৎপাদন ও রোগ নির্ণয় ঃ ভর্তিকৃত রোগীর রোগ নির্ণয় ও নিরাময় জরুরি। এক্ষেত্রে হাসপাতাল সমাজকর্মী রোগীর রোগ সম্পর্কিত ও তার আর্থ-মনো-সামাজিক প্রভৃতি দিকসমূহ পর্যালোচনা করার মাধ্যমে সত্য তথ্য উদঘাটন করে। ফলে ঐ রোগীটির রোগ নির্ণয় করা সহজ হয়।
৪. উদ্বুদ্ধকরণ ঃ হাসপাতালে রোগীকে চিকিৎসা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে থাকে সাধারণত সমাজকর্মী। তিনিই রোগীকে চিকিৎসা গ্রহণে সক্ষম করে তোলে।
৫. চিকিৎসার উপকরণ সরবরাহ : হাসপাতাল সমাজকর্মী অসহায় দুর্বল রোগীদের ঔষধপত্র, রক্ত পথ্য, ইনজেকশন স্যলাইনসহ অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী সরবাহ করে থাকে। শুধুমাত্র তাই নয়, ডাক্তারের পরামর্শমত কিভাবে এগুলো ব্যবহার করা যায় সেই বিষয়েও সা
হায্য প্রদান করে থাকে।
৬. সচেতনতার সৃষ্টি সাধন : হাসপাতাল সমাজকর্মীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে বিবেচিত হয় ব্যাপক সচেতনতার সৃষ্টি সাধন। এ ধরনের সমাজকর্মীরা গরীব-অসহায় রোগীদেরকে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা পরিবারে পরিকল্পনা গ্রহণ ও স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কিত বিষয়ে ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে জ্ঞানদান করে।
৭. রোগীকল্যাণ সমিতির পরিচালনা ঃ বাংলাদেশের হাসপাতালের রোগীদের কল্যাণে রোগীকল্যাণ সমিতি গঠন ও তা পরিচালনা করে থাকে মূলত হাসপাতাল সমাজকর্মী। বর্তমানে দেশে ৮৪টি ইউনিটে ৮৬টি এ ধরনের সমিতি রয়েছে।
৮. বিনোদনমূলক কাজ ঃ হাসপাতাল সমাজকর্মীরা রোগীদের কল্যাণার্থে বিনোদনমূলক কাজও করে থাকে। তারা
রোগীদের একাকিত্ব ও একঘেয়েমী ঘুচানো ও গঠনমূলক চরিত্র গঠনে আন্তঃক্রিয়া অনুষ্ঠানে, সাহিত্য পঠন, গল্প, কথন, বই পড়া এবং পত্র-পত্রিকা পড়া প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে থাকে।
৯. সংরক্ষণ ঃ হাসপাতাল সমাজকর্মীরা রোগীদের জীবন বৃত্তান্তের স্বরূপ-রোগের কারণ, প্রতিদিনকার উন্নতি- অবনতি প্রভৃতি অতিযত্নে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। সমাজকর্মীর এই সংরক্ষণই রোগীদেরকে পরবর্তীতে পুনর্বাসন ও সুস্থ জীবনযাপনে সাহায্য করে থাকে।
১০. রোগীদের পরামর্শদান ঃ যেসব রোগীদের ডাক্তারের সামনে সময়ে সময়ে হাজির হতে হয় তাদেরবে হাসপাতাল সমাজকমীগণ যথাযথভাবে পরামর্শের মাধ্যমে সহায়তা করে। তাছাড়া অসহায় রোগীর অনেক কিছুই বুঝানে সেখানে একজন সৎ পরামর্শক হিসেবে সমাজকর্মী ভুমিকা পালন করে থাকে।
১১. রোগীকে বাসায় প্রেরণ : চিকিৎসা সেবাশেষে হাসপাতালে সমাজকর্মীরা দুর্বল অসহায় রোগীদের বাসায় প্রেরণের ব্যবস্থা করে থাকে। যাতে করে কষ্ট কিছু লাঘব হয় ।
১২. পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ঃ হাসপাতাল সমাজ কর্মীরা শুধু গরিব রোগীদের চিকিৎসা সেবা গ্রহণেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সেবা পরবর্তীতে দুর্বল অসহায় রোগীদের মাঝে যাতে পুনরায় ব্যাধির সংক্রামক ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে থাকে। যাতে পরবর্তীতে অসুস্থ হয়ে পড়লে
দ্রুত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে ।
১৩. ফলোআপ করা ঃ বাংলাদেশের হাসপাতাল সমাজকর্মীর অন্যতম কাজ হলো ফলোআপ করা। এটি তাদের দায়িত্বও বটে। চিকিৎসা সেবা শেষে যেসব রোগী বাসায় ফিরে তাদের নিয়মিত খোঁজখবর নিয়ে থাকে সমাজকর্মী রোগীরা আর যেন রোগাক্রান্ত না হয়ে পড়ে সেজন্য ফলোআপের মাধ্যমে খোঁজখবর রাখা হয়।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, হাসপাতাল সমাজকর্মী বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করছে। তারা রোগীদের পরমবন্ধু, ডাক্তার ও রোগীর মধ্যকার সম্পর্কের সেতুবন্ধন। দুর্বল অসহায়, নিজস্ব রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা গ্রহণে সজাগ করা থেকে আনা, বিভিন্ন পরামর্শদান, চিকিৎসা গ্রহণে সার্বিক সাহায্যসহ বাসায় ফিরিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পর্যন্ত করে থাকে। এই হাসপাতাল সমাজকর্মীর সহায়তায় বাংলাদেশের লাখ লাখ গরিব চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণে সফল হচ্ছে। তাই, হাসপাতাল সমাজকর্মীর ভূমিকা অত্যধিক।