সাদারল্যান্ডের বিভিন্নমুখী মেলামেশা মতবাদের সমালোচনা কর।

অথবা, তুমি কিভাবে সাদারল্যান্ডের বিভিন্নমুখী মেলামেশা মতবাদের সমালোচনা করবে।
অথবা, সাদারল্যান্ডের বিভিন্নমুখী মেলামেশা তত্ত্বকে যুক্তির ভিত্তিতে সমালোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ব্যক্তির ও প্রতিষ্ঠানের বিচ্যুতিমূলক আচরণের উপর সামাজিক কাঠামো তথা সামাজিক সম্পর্কের প্রভাব লক্ষণীয়। মানুষ যখন পরিবারের গণ্ডি থেকে বের হয়ে সমাজের সদস্যদের সংস্পর্শে আসে তখন তার আচার আচরণে পরিবর্তন দেখা যায়। অন্যের কর্মকাণ্ড অথবা চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ বিচ্যুতিমূলক কাজের
উৎসাহ পায়। মানুষের এ ধরনের বিচ্যুতিমূলক আচরণ নিয়েই বিখ্যাত অপরাধবিজ্ঞানী এডউইন এইচ. সাদারল্যান্ড তাঁর তত্ত্ব প্রদান করেছেন, যা Differential association theory বা বিভিন্নমুখী মেলামেশা তত্ত্ব নামে পরিচিত সাদারল্যান্ড এর বিভিন্নমুখী মেলামেশা মতবাদের সমালোচনা : যদিও সাদারল্যান্ড এর বিভিন্নমুখী মেলামেশার তত্ত্বটি সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব পেয়েছে, তথাপি তাঁর তত্ত্বটি নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. অস্পষ্ট এবং অসম্পূর্ণ : সাদারল্যান্ড এর তত্ত্বের বক্তব্য সুস্পষ্ট নয়। তাঁর প্রস্তাবনাগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা হয় নি। তাই Differential association সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায় না।
২. অপরাধীর সাথে মেলামেশা করার প্রভাব : অপরাধীর সাথে মেলামেশা করলেই মানুষ অপরাধী হচ্ছে এমন ধারণা ঠিক নয়। অপরাধীর সাথে মেলামেশা করেও মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। আবার অপরাধী নয় এমন অনেকের সংস্পর্শে এসেও মানুষ অপরাধ করে। তদুপরি তিনি অপরাধীদের সাথে মেশার মাধ্যমে অপরাধী হওয়ার শিক্ষা।পেয়ে অপরাধ থেকে যে দূরে থাকা যায়, তার উল্লেখ করেন নি।
৩. মানুষের মুক্ত ইচ্ছার উপেক্ষা : এ তত্ত্বে মানুষের মুক্ত ইচ্ছার গুরুত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। মানুষ নিজস্ব চিন্তাশক্তির দ্বারাও অপরাধী হতে উৎসাহিত হতে পারে সে কথা সাদারল্যান্ড উল্লেখ করেন নি। মেলামেশার সময়ে মানুষ নিজের বুদ্ধিবৃত্তির মনোভাব দ্বারাই চালিত হবে, একথা উপেক্ষা করা হয়েছে ।
৪. অপরাধের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে না : এ মতবাদে অপরাধীর সংস্পর্শে আসার ফলে অপরাধপ্রবণ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু উল্লিখিত অপরাধী ব্যক্তিরা কিভাবে অপরাধী হলো সে উল্লেখ নেই। অর্থাৎ সাদারল্যান্ড তাঁর মতবাদে অপরাধের উৎস বা উৎপত্তির ব্যাখ্যা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন।
৫. শারীরবৃত্তীয় কারণ অস্বীকার : অপরাধের জৈবিক কারণকে এ তত্ত্বে স্বীকার করা হয় নি। অপরাধের কারণ হিসেবে শুধু বিভিন্নমুখী মেলামেশাকেই এ তত্ত্বে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
৬. অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে উপেক্ষা : সাদারল্যান্ড তার তত্ত্বে অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়কে উপেক্ষা করেছেন। অর্থের সংকট কিংবা মানসিক হতাশাগ্রস্ত হয়েও যে ব্যক্তি অপরাধ করতে পারে তা না বলে তিনি শুধু মেলামেশাকে অপরাধের প্রধান এবং একমাত্র কারণ বলে দায়ী করেছেন।
৭. তত্ত্বের কাঠামোগত দুর্বলতা : এ মতবাদে অপরাধী এবং অপরাধ বিরোধী দুধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসার কথা বলা হয়েছে। এতে করে অপরাধ প্রবণতার পাশাপাশি অপরাধ দমনের শিক্ষাও পাওয়া যায়। এটি তাই অপরাধ তত্ত্ব না হয়ে মানব আচরণ শিক্ষার তত্ত্বে পরিণত হয়েছে
৮. কার্যকরী ক্ষমতা কম : তত্ত্বটি অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর নয়। অনেক অপরাধ, যেমন- অর্থ আত্মসাৎ, ভদ্রবেশী অপরাধ, ইত্যা, আবেগগত অপরাধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব তেমন কার্যকরী নয়।
৯. ব্যক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হয় নি : সাদারল্যান্ড-এর Differential association theory ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মনস্তাত্ত্বিক উপাদান এবং ব্যক্তিত্বের মৌল কাঠামোর উপর গুরুত্ব প্রদান করে না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পারস্পরিক মেলামেশা মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে অস্বাভাবিক করে দিয়ে অপরাধ সংগঠন করায়। সাদারল্যান্ড তাঁর Differential তত্ত্বে একথাই বলতে চেয়েছেন। এভাবে তাঁর তত্ত্ব অপরাধের সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটকে গবেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।