অথবা, সামাজিক বিচ্যুতির জন্য দায়ী কারণগুলো আলোচনা কর।
অথবা, কিভাবে বিচ্যুতি ঘটে? বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে স্ব-স্ব সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও মূল্যবোধ এবং আইন মেনে চলতে হয়। আবার মানুষ তার স্বীয় অস্তিত্বের বাইরে অতিপ্রাকৃত একটি শক্তির অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে, যার ভিত্তি হলো কতকগুলো Rule, অনুশাসন ও বিধিনিষেধ মেনে নেয়া। সে ধর্মীয় বিধিনিষেধ পরিপন্থী কাজই হলো পাপ, যা থেকে বিচ্যুতি ও অপরাধকে পার্থক্য করা যায় না। মূলত সমাজে প্রচলিত যাবতীয় সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিভঙ্গ করাই হলো বিচ্যুতি ও অপরাধ।
বিচ্যুতির কারণ : অপরাধবিজ্ঞানের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যবিষয়ের মধ্যে বিচ্যুতি সম্পর্কিত আলোচনা অন্যতম। কথায় বলে, “Rules are broken because rules are there.” বস্তুত কোন নীতি আছে বলে আমরা বুঝতে পারি কোন কাজ নীতিহীন এবং তাকেই বিচ্যুতিমূলক আচরণ বলে গণ্য করা হয়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধের
ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী এ বিচ্যুতি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজ তাত্ত্বিকগণ বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য তিনটি প্রধান প্রত্যয়কে দায়ী করেছেন। যথা :
ক. জৈবিক কারণ (Biological explanation), নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো :
ক. জৈবিক কারণ (Biological explanation) : বিচ্যুতিমূলক আচরণের কারণ ব্যাখ্যায় বিভিন্ন অপরাধবিজ্ঞানীরা
এর কতকগুলো জৈবিক কারণ উদ্ঘাটন করেন। তাদের বক্তব্য হলো, অপরাধীরা নিরপরাধ ব্যক্তির চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের
অধিকারী এবং অস্বাভাবিক ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণেই বিচ্যুতিমূলক আচরণ করে। এ প্রেক্ষিতে তারা Physiognomy এবং
Phrenology এর কথা বলেছেন। বিচ্যুতিমূলক আচরণের জৈবিক কারণ উদ্ঘাটন করে যারা মতামত প্রকাশ করেন তাদের মধ্যে, Lambroso এর নাম সর্বাগ্রে। তাকে সমর্থন করে বক্তব্য রেখেছেন Sheldon, Ferri, Goring, Hooton প্রমুখ।
মনস্তাত্ত্বিক কারণ (Psychological explanation) এবং সামাজিক কারণ (Social explanation)। Lambroso, Cesare এর মতামত: Lambroso তাঁর ‘Positive School of Criminology’ গ্রন্থে অপরাধীদের আচরণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, পূর্বপুরুষের লুপ্ত প্রায় জৈবিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিচ্যুতির কারণ ব্যাখ্যা করা যায়। তিনি সহস্রাধিক কয়েদির উপর Study করে বিভিন্ন ধরনের দৈহিক অস্বাভাবিক ও কিম্ভূতকিমাকার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য
করেন, যা বিচ্যুতিমূলক আচরণকারী তথা অপরাধীকে চিহ্নিত করতে সহায়ক বলে বিবেচিত হয়। তিনি বেশকিছু শারীরিক
বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। যথা :
অসামঞ্জস্যপূর্ণ মুখ (Asymmetrical face),
পশ্চাৎগামী কপাল (Receding forehead),
মাংসল ও স্ফীত ঠোঁট (Fleshy and swollen lips), অপর্যাপ্ত দাড়ি (Scant beard),
দীর্ঘ বাহু (Long arms), অস্বাভাবিক দন্তাদগম (Abnormal dentition), অস্বাভাবিক থুতনি (Abnormal chin),
অস্বাভাবিক মাথা (Abnormal head)
Lambroso তাঁর গবেষণা থেকে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন তা হলো, Deviant বা Criminal বা অপরাধীরা জন্মগতভাবেই অপরাধী। আর শারীরিক কারণেই মানুষ Deviant হয়।
খ. মনস্তাত্ত্বিক কারণ (Psychological Explanation) : আধুনিককালের সমাজবিজ্ঞানীরা বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য জৈবিক কারণের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক কারণকেও দায়ী করেছেন। সাম্প্রতিক কালের সমাজচিন্তাবিদরা বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য সাধারণত Mental defects, Degeneracy (অধঃপতন), Feeblemindedness and Psycholothy ইত্যাদি কারণগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অপরাধবিজ্ঞানীরা এ ধরনের বৈশিষ্ট্য এবং অপরাধমূলক আচরণের মধ্যকার সম্পর্ক জানার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। তাই মনোবিশ্লেষকগণ বিভিন্ন
প্রকার মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাবলিকেই অপরাধমূলক আচরণের জন্য দায়ী করেছেন। প্রধানত Sign und Freud এর মতামত
উল্লেখযোগ্য। এছাড়া Jhon Dollard ও Colleagues এ বিষয়ে মতামত প্রদান করেন।
সিগমন্ড ফ্রয়েডের মতামত : সমাজ মনোবিজ্ঞানী Sigmund Freud ব্যক্তির বিচ্যুতিমূলক আচরণকে ব্যাখ্যা করতে
গিয়ে দু’টি প্রত্যয় ব্যবহার করেন। যথা :
- Super ego strength.
- Ego strength.
: 1. Super ego strength : Freud মনে করেন, কোন ব্যক্তির নীতিজ্ঞান গড়ে উঠে তার শৈশবে বড়দের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটলে তার Super ego গড়ে উঠে না। ফলে Super ego এর অনুপস্থিতির কারণে তার মাঝে কোন অনুভূতি বা অপরাধবোধ জাগায় না। ফলে তার মধ্যে বিচ্যুতিমূলক আচরণের প্রকাশ ঘটে। - Ego strength : সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দুর্বল Ego ব্যক্তির নীতিজ্ঞানহীনতার কারণ নয়, বরং ব্যক্তির কার্যকলাপকে সংঘটিত করতে ব্যর্থতার ফলে তার আচরণে বিচ্যুতি আসতে বাধ্য।
গ. সামাজিক কারণ (Sociological explanation) : যেহেতু Deviance behaviour যেহেতু Social norms এর সাথে সম্পৃক্ত, সেহেতু সামাজিকভাবেই এর মাত্রা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ, সমাজই নির্ধারণ করে কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয়। এ কারণে সমাজতাত্ত্বিকগণ অনুসন্ধান করে দেখেছেন, সামাজিক বিবিধ কারণেই মানুষ Deviant হয়
বেশি। তারা এজন্য Family কে দায়ী করেছেন। যেমন- Inadequate family, Broken family, Over crowd family, Poverty striken family, Criminal family ইত্যাদিসহ বিভিন্ন Social Institution কে দায়ী করেছেন। এ প্রেক্ষিতে Cause of deviant behaviour সম্পর্কে বিভিন্ন Sociologist দের মতামত নিম্নে তুলে ধরা হলো :
সাদারল্যান্ডের মতামত : (Differential Association) বিচ্যুতিমূলক আচরণকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাদারল্যান্ড and Cresscy তাঁদের ‘Principles of Criminology’ গ্রন্থে Differential Association বা বিভিন্নমুখী মেলামেশাকে
দায়ী করেছেন। তাঁদের মতে, বৃহৎ সমাজের মধ্যে ছোট ছোট এমন অনেক Criminal Sub-culture থাকে, যাদের সংস্পর্শে এসে ব্যক্তি ক্রমশ Deviance এর দিকে ধাবিত হয়।
এমিল ডুরখেইমের তত্ত্ব : Durkheim যে তত্ত্ব দিয়েছেন তা একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে। সেটি হলো আত্মহত্যা। তিনি তার ‘Suicide’ গ্রন্থে এ আত্মহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এ আত্মহত্যা অস্বাভাবিক হলেও তা একরকম নয়। তিনি আত্মহত্যাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন।
এ আত্মহত্যার মধ্যে রয়েছে একটা পরার্থমূলক আত্মহত্যা। যেমন- যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার কারণে জাতীয় অবমাননাকে মানতে না পেরে দলে দলে আত্মহত্যা করে। জাপানে একে বলে ‘হারিকিরি’ ।
তিন ধরনের আত্মহত্যা হলো :
Suicide
Altruistic
Egoistic
Anemic - Altruistic suicide: A murder is not a case of suicide. সমাজের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক যখন নিবিড় তথা ব্যক্তিসত্তা যখন সমষ্টি সত্তায় রূপান্তরিত হয় তখন বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। এ ধরনের আত্মহত্যাকে বলা হয় Altruistic suicide. যেমন- জাপানের হারিকেনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পরে সৈন্যরা তাদের নিজেদের পেট নিজেরা কেটে আত্মহত্যা করেছিল। এর কারণ হলো তারা তাদের
সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে পারে নি। এছাড়াও হিন্দুদের সহমরণ রীতিকে এর সাথে তুলনা করা চলে। - Egoistic suicide : নিজস্ব সত্তার উপর আঘাত আসলে ব্যক্তি গভীরভাবে Irretional হয়ে পড়ে। তখন এ ধরনের আত্মহত্যা বেশি ঘটে। নিজের ব্যক্তিত্বের একটা অবমাননা ঘটার ফলে লজ্জায়, মানসিক আপত্তি, পারিবারিক গোলযোগ, প্রেমে ব্যর্থতা, সম্পদের ক্ষতি এসব কারণে আত্মহত্যা করে।
- Anomic suicide: Emile Durkheim বিচ্যুতিমূলক আচরণের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে Anomic কে দায়ী করেন। ‘Stage of Normlessness’ এক্ষেত্রে মানুষের আদর্শের মূল্যবোধ নেই। তার কাছে সবকিছুই অর্থহীন।
বিশেষ করে সামাজিক পরিবর্তনের ক্রান্তিলগ্নে এ ধরনের রোগাক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করে। এখানে ব্যক্তিসত্তার হত্যা হচ্ছে না। এ মানসিকতা থেকে সে নানা ধরনের অপরাধ করতে পারে। কারণ তার কাছে সব অপরাধই বৈধ মনে হয়। সে এক্ষেত্রে একটা মানসিকতা আসে যখন ন্যায় অন্যায়বোধ থাকে না। যখন সে নিজের জীবনকে অর্থহীনভাবে, তখন সে
অন্যের জীবনকে অর্থহীনভাবে। এ যে বিশেষ মানসিকতা তাকেই তিনি Anomic বলেছেন ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সামাজিক মূল্যবোধকে ও Folkways কে নস্যাৎ করে ব্যক্তি সমাজে যে Deviant behaviour করে তার জন্য সমাজতাত্ত্বিকগণ জৈবিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বিভিন্ন কারণকে দায়ী করলেও একথা ঠিক যে, অন্য যে কোন কারণের চেয়ে সামাজিক কারণেই মানুষ সবচেয়ে বেশি বিচ্যুতিমূলক আচরণ করে থাকে।