অথবা, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বঙ্গরন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক মহান নেতা। যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ হয়ত স্বাধীন হতো কি না তা বলা মুশকিল। এ মহান নেতা হলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। বাংলার এ অবিসংবাদিত নেতা সম্মোহনী নেতৃত্ব গ্রহণের পর সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। তাঁর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার নতুন সূর্য। স্বাধীনতার পর ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানাবিধ জটিল সমস্যার মধ্যে তিনি দেশ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের শাসনামলে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি : ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শাসনাকাল ছিল। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি হলো :
১. বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়াওয়ালী কারাগার থেকে ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান এবং লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন এবং দেশ পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
২. সংবিধান প্রণয়নের অধ্যাদেশ : সংবিধান প্রণয়ন ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন এবং সংবিধান তৈরির জন্য গণপরিষদ গঠন করেন। এ সংবিধান গণপরিষদে বিধিবদ্ধ হয় ।
৪ নভেম্বর ১৯৭২ : ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে এটি কার্যকর হয়।
৩. সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন : পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনতা দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছিল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার জন্য। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি অস্থায়ী সংবিধান আদেশ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সংসদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল।
৪. জাসদের জন্ম : সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি গোষ্ঠী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। তারা প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে হঠাৎ করেই একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের দাবি মেনে নেওয়া
সম্ভব ছিল না। ফলে জনাব সিরাজুল আলম খানের আশীর্বাদ ও পৃষ্ঠপোষকতায় আ. স. ম আব্দুর রব এবং শাজাহান সিরাজ ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর “জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল” গঠন করেন।
৫. স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন : ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের মতামত যাচাই করার জন্য দ্রুত এ সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।
৬. বাংলাদেশ সংবিধানের প্রথম সংশোধনী : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই সংবিধানের প্রথম সংশোধনী গৃহীত হয়। গণহত্যা এবং যুদ্ধ অপরাধে লিপ্ত পাকিস্তানি সৈন্যসহ অন্যান্যদের বিচারের জন্য এ সংশোধনী করা হয়। এ সংশোধনীর ফলে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধজনিত অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়।
৭. সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী : এ সংশোধনীর মাধ্যমে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান রাখা হয়। যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণে বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে বাংলাদেশ বা এর কোনো অংশবিশেষ
আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনী গৃহীত হয়।
৮. সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর এ সংশোধনীটি গৃহীত হয়। এ আইনের মাধ্যমে দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় কিছু রদবদল হয় যা সংশোধনী মারফত কার্যকর হয়।
৯. সাত দলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন : ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি সাত দলীয় কমিটি গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু সরকারের পদত্যাগ, সর্বদলীয় সরকার গঠন প্রভৃতি লক্ষ্যে এ কমিটি কাজ করে।
১০. আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী শক্তির উন্মেষ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচণ্ড প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের ভিত্তিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায় যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
১১. গণ ঐক্যজোট : ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মো.) ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিং) ত্রিদলীয় গণ ঐক্যজোট গঠন করে।
১২. সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী : বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের অন্যতম ঘটনা ছিল সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও আদর্শ পরিবর্তিত হয়ে যায়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয় ।
১৩. বাকশাল গঠন : বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বাকশাল গঠন। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়। বাকশাল গঠনের পাশাপাশি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংকুচিত করা হয়।
১৪. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তন : চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তন করা হয়। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে প্রভূত ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীন দেশের ক্ষমতা গ্রহণের পর নানা কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ সংগ্রাম করেছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও চিন্তাধারার মূলে আঘাত হানে। নকশালপন্থি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলগুলোও বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়, যার ফলে বঙ্গবন্ধুর সরকার রাজনৈতিক অস্থিরতায় পতিত হয়।