১৯৭৫ সালে গৃহীত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর বিষয়বস্তু আলোচনা কর।

অথবা, ১৯৭৫ সালে গৃহীত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তু বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সংবিধান একটি জাতির দর্পণস্বরূপ। একটি রাষ্ট্র কীভাবে গঠিত হবে কীভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ভর করে সংবিধানের উপর। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের একদিকে ছিল স্বীকৃতি অন্যদিকে সংবিধান প্রণয়ন ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান কমিটি গঠিত হয়। অবশেষে গণপরিষদ ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান বিধিবদ্ধ করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে স্থায়ী সংবিধানরূপে কার্যকরী হয়। এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রয়োজন ও বাস্তবতার কারণে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১৬ বার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। এর মধ্যে চতুর্থ সংশোধনী ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এ সংশোধনী রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন ঘটায়।
চতুর্থ সংশোধনীর বিষয়বস্তু : অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি প্রভৃতি পুরো সরকার ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলে এরূপ পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আইন প্রণয়ন ও বিধিবদ্ধ করেন। নিচে চতুর্থ সংশোধনীর বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো :
১. একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন : চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে বহুদলীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তার নামকরণ করা হয় জাতীয় দল তথা বাকশাল। সংশোধনীতে আরো বলা হয় যে, কোনো সংসদ সদস্য যদি জাতীয় দলের সদস্য না হয় তাহলে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য পদ হারাবেন।
২. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার : চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রকৃত শাসনব্যবস্থার মধ্যমণি।
৩. মন্ত্রিপরিষদ গঠন : চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে মন্ত্রিসভার উল্লেখ করা হয় তা ছিল রাষ্ট্রপতির ইচ্ছাধীন।রাষ্ট্রপতিকে সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকবে। রাষ্ট্রপতি তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদেরকে নিয়োগ করবেন এবং তারা রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনুযায়ী স্বীয় পদে বহাল থাকবেন।
৪. উপরাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি : চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একজন উপরাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করা হয়। রাষ্ট্রপতি উপরাষ্ট্রপতিকে নিয়োগ করবেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি কাজ করবেন।
৫. নিষ্ক্রিয় আইন পরিষদ : চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আইন বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার সন্নিবেশ ঘটে। সংসদ নির্বাহী বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারায়।
৬. বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব : চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের মূল ভিত্তিসহ গোটা কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন সাধন করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে বিচারক নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয় এবং তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে বিচারক নিয়োগে বাধ্য ছিলেন না (অনুচ্ছেদ ৯৫) এবং অপসারণের ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়।
৭. বহুমুখী গ্রামীণ সমবায় ব্যবস্থা প্রবর্তন : অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চতুর্থ সংশোধনীর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুমুখী গ্রামীণ সমবায় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে বহুমুখী গ্রামীণ সমবায় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
৮. মৌলিক অধিকার সংকোচিত : মূল সংবিধানে উল্লেখ ছিল জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবেন। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সে অধিকার বাতিল করা হয়।
৯. রাষ্ট্রপতির অপসারণ পদ্ধতি : চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অপসারণ পদ্ধতি জটিল করা হয়। পূর্বে শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যের কারণে কিংবা সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য জাতীয় সংসদের মোট সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা যেত। কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে মোট সদস্যের শতকরা
৭৫ ভাগ সদস্যের সমর্থন প্রযোজন হয়।
১০. নিষ্ক্রিয় মন্ত্রিসভা : পূর্বে সংবিধানে মন্ত্রিসভা গঠিত হতো জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য কর্তৃক। কিন্তু এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি যে কোনো লোককে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করতে পারবে এবং বাস্তবায়ন করতে পারবে।
১১. জাতীয় সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি : চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। চতুর্থ সংশোধনী দ্বারা ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সংসদের কার্যকাল ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি হতে ৫ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সংশোধিত সংবিধানের অধীনে পূর্ণ ৫ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বলে
ঘোষণা করা হয়।
১২. স্থানীয় প্রশাসন : চতুর্থ সংশোধনীতে সরকারের এককেন্দ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে তৃতীয় ভাগটিতে বিকেন্দ্রীকরণের অংশটি বাদ দেওয়া হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় রাখার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ সংশোধনী পাস করান। এ সংশোধনী সংবিধানে এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করে। এ চতুর্থ সংশোধনী বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।