বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নেপথ্য কাহিনি কী?

উত্তরী ভূমিকা : অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জাতীয় পতাকার আকৃতি, গড়ন, রং ও পতাকা উত্তোলনের ধরনের কিছু অনুমোদিত নিয়মকানুন অনুসরণ করে। পতাকা বিধি ১৯৭২ অনুসারে জাতীয় পতাকার রং হবে গাঢ় সবুজ এবং ১০ : ৬ অনুপাতে আয়তাকার, তাতে থাকবে সবুজ অংশের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মাঝের লাল বৃত্তের ভিতর হলুদ রঙের একটি মানচিত্র ছিল ।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নেপথ্য কাহিনি : বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নেপথ্যে রয়েছে একটি সুপরিকল্পিত কাহিনি যাতে লক্ষ করা যায় ১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে “একটি “জয় বাংলা বাহিনী” মতান্তরে “ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী” গঠন করা হয়। সে সময় ছাত্রনেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এ উপলক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ.স.ম. আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ মার্শাল, মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারি দর্জির দোকান (নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স) থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন। এরপর ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদ আজম হল (বর্তমান তিতুমীর হল) এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছে থেকে মানচিত্রের বই নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকেন
পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস পরিশেষে তার নিপুণ হাতে মানচিত্রটি লাল বৃত্তের মাঝে আঁকেন ।
প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও মার্জিত রূপ দান : ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন আ.স.ম. আব্দুর রব। ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর বাসভবনে এ পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ণ দাসের ডিজাইনকৃত পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রং ও তার ব্যাখ্যা সংবলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলেন কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসানের দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
জাতীয় পতাকার পরিমাপ : পতাকা বিধি ১৯৭২ অনুসারে জাতীয় পতাকার রং হবে গাঢ় সবুজ এবং ১০ : ৬ অনুপাতে আয়তাকার, তাতে থাকবে সবুজ অংশের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত। লাল বৃত্তের ব্যাসার্ধ হবে পতাকার মোট দৈর্ঘ্যের এক পঞ্চমাংশ। বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুর অবস্থান হবে পতাকার দৈর্ঘ্যের ৯/২০ অংশ থেকে টানা লম্বের এবং প্রস্থের মাঝখান দিয়ে টানা আনুভূমিক রেখার ছেদবিন্দুতে, পতাকার সবুজ অংশ হবে প্রসিয়ন গাঢ় সবুজ এইচ-২ আর, এস. হাজারে ৫০ ভাগ হিসেবে লাল বৃত্তের অংশ হবে প্রসিয়ন উজ্জ্বল কমলা রং এইচ-২ আর. এস. হাজারে ৬০ ভাগ হিসেবে। ভবনের আকারভেদে পতাকার আকার হবে ১০′ × ৬’; ৫’ × ৩’; ২২′ × ১২, মোটর গাড়িতে ব্যবহৃত পতাকার সাইজ হবে বড়গাড়ি = ১৫” × ৯” ও ছোট ও মাঝারি গাড়ি ১০” × ৬” এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত টেবিল পতাকার সাইজ হবে ১০” × ৬”।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রথম অবস্থায় পতাকার কেন্দ্রস্থলে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত ছিল। পরে তা বিলোপ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ছাত্রনেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প তাকা উত্তোলন করেন সে পতাকার আদলে মুজিবনগর সরকার জাতীয় পতাকার নমুনা নির্ধারণ করেন।