সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর যৌক্তিকতা তুলে ধর।

অথবা, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধর।
উত্তর ভূমিকা :
সংবিধানের সংশোধনীসমূহের মধ্যে চতুর্থ সংশোধনী ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে জনগণের ইচ্ছার
প্রতিফলন হিসেবে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে সংসদীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশে শান্তি শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে চতুর্থ সংশোধনী আবশ্যক হয়ে পড়ে।
চতুর্থ সংশোধনীর যৌক্তিকতা : নিচে চতুর্থ সংশোধনীর যৌক্তিকতা তুলে ধরা হলো :
১. সশস্ত্র বিদ্রোহ দমন : সংসদীয় শাসনামলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মতাদর্শ ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে। এরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় স্বশাসন জারি করে। দেশদ্রোহীমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে।
২. জনগণের জানমাল রক্ষা : সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় দেশের জনগণ জীবন ও সম্পত্তি হুমকির সম্মুখীন হয়। খুন, ধর্ষণ ও গুপ্তহত্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
৩. বিভিন্ন বামপন্থি দলের অপতৎপরতা : জাসদসহ দেশের বিভিন্ন বামপন্থি রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে ও গোপনে বিপ্লবী তৎপরতা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে জাসদ। ফলে শাসনতন্ত্র পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়ে।
৪. বিপর্যস্ত অর্থনীতি : সরকার যে অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে তা সংকটের মুখে পড়ে। কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। ফলে এ দুরবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়।
৫. ব্রিটিশদের আমলাতান্ত্রিক শাসনের অবসান : স্বাধীনোত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক সংস্কারমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রশাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য উপযোগী ছিল না। ফলে দেশে সুশাসন হুমকির মুখে পড়ে। শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে চতুর্থ সংশোধনী প্রয়োজন হয়।
৬. মতভেদ ও কোন্দলের সৃষ্টি : আওয়ামী লীগের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তীব্র মতভেদ ও কোন্দল সৃষ্টি হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদীয় গণতন্ত্র অপেক্ষা রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তন করাই উপযুক্ত বলে মনে করেন।
৭. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন : তৎকালীন সময়ে দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থার চরম অবনতি ঘটে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এরূপ পরিস্থিতিতে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার আবশ্যক হয়ে পড়ে।
৮. জাতীয় দল গঠন পরিকল্পনা : স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অভ্যন্তরীণ চাপের কারণেই সংসদীয় শাসনের প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থন চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত হয়। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে এক দলীয় শাসন প্রবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। তৎকালীন পরিস্থিতিতে এর বিকল্প পথ কমই খোলা ছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু তার শাসনামলে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। কিন্তু দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সশস্ত্র বিদ্রোহী তৎপরতা, গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নীরব দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির ফলে দেশ সংকটে পড়ে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে আওয়ামী লীগ সরকার সচেষ্ট হয়। দেশের অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলার চরম অবনতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী গ্রহণ করেন।