অথবা, বিদেশি পত্রিকা অবলম্বনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার চিত্র বর্ণনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি পত্রিকাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। গণহত্যার বিস্তার ও নিষ্ঠুরতা এতই বেশি ছিল যে, তা বিদেশি গণমাধ্যমগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধে বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনে বিদেশি পত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বাংলাদেশের গণহত্যার বিবরণ : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ লাখো মানুষকে হত্যা করা হয়। নির্বিচারে ধ্বংস করে দেওয়া হয় বাংলাদেশের অসংখ্য জনপদ। নিচে এ বিষয়ে বর্ণনা করা হলো :
১. ডেইলি টেলিগ্রাফ : লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা সাইমন ডিং এর প্রতিবেদন থেকে বিশ্ববাসী সর্বপ্রথম বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে তার বর্ণনায় বলেছিলেন, রাত ১০ টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে, পুরোনো ঢাকা, রাজারবাগ, পিলখানা প্রভৃতি স্থানে গণহত্যা শুরু করেছিল। ৩১ মার্চ ১৯৭১ সাল গণহত্যা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। যেমন- ‘আল্লাহ এবং পাকিস্তানের ঐক্যের নামে’ ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত ও সন্ত্রস্ত নগরী, দীর্ঘ ২৪ ঘণ্টার নৃশংস অভিযান, ঠাণ্ডা মাথায় বোমাবর্ষণ এং গোলাগুলি চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কমপক্ষে ৭ হাজার মানুষ হত্যা করেছে, তারা বিশাল এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর এ বর্বর অভিযানকে আন্দাজ করা যাবে বিছানাতে
ছাত্রদের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে। ভস্মীভূত ঘরবাড়িতে আগুনে পোড়া নারী ও শিশুর দেহ দেখে ।
২. টাইমস অফ ইন্ডিয়া : টাইমস অফ ইন্ডিয়া বাংলােেদশের গণহত্যার খবর প্রকাশ করে। আমেরিকার এক কর্মসূচিতে কর্মরত এক আমেরিকান কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সামনে যে জবানবন্দী দেন তা টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে ২ মে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন “পূর্ব বাংলার জনগণের আইন চালু রয়েছে, সুপরিকল্পিত
উপায়ে নিরস্ত্র বেসামরিক জনসাধারণ, বুদ্ধিজীবী ও হিন্দুদের হত্যা করা হয়। তিনি ২৯ মার্চ ১৯৭১ রমনা কালীবাড়ি পরিদর্শন করে দেখেন যে, সেখানে ২০০ থেকে ৩০০ লোককে হত্যা করা হয়েছে। মেশিনগানের গুলি খেয়ে, আগুনে পুড়ে নরনারী ও শিশুদের মৃতদেহ পড়ে আছে।”
৩. সানডে টাইমস : সানডে টাইমস পত্রিকা লন্ডন থেকে প্রকাশিত হতো। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তানস্থ প্রতিনিধি জানায় যে, পুরোনো ঢাকায় কয়েকটি এলাকা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সময় সান্ধ্য আইনের সময় যে শত শত মুসলমানদের পাকড়াও করা হয়েছিল তাদের কোনো চিহ্ন পরবর্তীতে আর মিলেনি। ১৫ এপ্রিল ১৯৭১
তিনি ঢাকায় ঘোরবার সময় দেখেছেন যে, “ইকবাল হলের দুটি সিঁড়িতে প্রচুর রক্ত তখনো ছড়িয়ে আছে এবং হলের ছাদে ৪ জন ছাত্রের মাথা তখনো পচছে। দেওয়ালে গুলির দাগ এবং রীতিমতো ডিডিটি পাউডার ছড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও চারিদিকে দুর্গন্ধ । মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ২৩ জন মহিলা ও শিশুর পচা লাশ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
৪. সানডে টেলিগ্রাফ : লন্ডনে সানডে টেলিগ্রাফ ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে গণহত্যা সম্পর্কে আলোচনা ও মন্তব্য লেখে। গত সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নৃশংসভাবে গণপ্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ হিসেবে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারগামী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের জীবনীশক্তি নিঃশেষ করা ছাড়া আর সবই করেছে। পাকিস্তানের জেনারেল ও কর্নেলরা
খুব
সাবধানে দু’বছর ধরে যে পরিকল্পনা করেছে তারই ফল এ নৃশংসতা। তাদের অনেকে ব্রিটিশদের হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত, অনেকেই চারিত্রিক নম্রতায় কোমল স্বভাবের হলেও বাহ্যিক ব্যবহারে ব্রিটিশদের চাইতেও ব্রিটিশ।
৫. লা এক্সপ্রেস : লা এক্সপ্রেস পত্রিকা ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হতো। এ পত্রিকায় সাংবাদিক তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। যেমন- প্রতিরাতেই আমি মেশিনগান ও মর্টারের গুলির শব্দ শুনতাম। বাঙালিদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে ধরত পাকিস্তানি সৈন্যরা। তারপর যানবাহনের পিছনে এমনভাবে বেঁধে দিত যাতে তাদের মাথা মাটিতে বারবার এসে আঘাত হানে।
৬. ভারতীয় পত্রিকায় গণহত্যা : ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় গণহত্যার খবর প্রকাশ করা হতো। ভারতীয় পত্রিকাগুলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ইতিবাচক সমর্থন প্রদান করে। অমৃতবাজার, যুগান্তর, আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান টাইমস প্রভৃতি পত্রিকা পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর প্রতিনিয়ত প্রকাশ করতে থাকে, যা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ।
মার্কিন পত্রিকায় গণহত্যা : মার্কিন পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, বাল্টিমোর সান, টাইম নিউজউইক পত্রিকাগুলো মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও ধ্বংসের খবর প্রচার করে জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বিদেশি পত্রিকাগুলো বাংলােদশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল । পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যার উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্ব জনমত গঠন করে। এ বিশ্ব জনমত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, যা মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছিল একটি ইতিবাচক দিক।