স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রভাব আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশ রাষ্ট্র উদ্ভবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে মহান স্বাধীনতা। আর এ স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন দিয়েছে বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতির ৩০ লক্ষ শহিদের জীবনের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এ স্বাধীনতার বীজবপন ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে হলেও ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্বও কম ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম করে। আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির সমর্থন পেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল : ১৯৭০ সালের নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ভোটের হার ছিল ৫৫.০৯% এবং সমগ্র পাকিস্তানে ছিল ৫৭.৯৫%। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভোটের ৭৫.১০% এবং ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি লাভ করে। অবশিষ্ট ২ আসনের মধ্যে ১টি পান পি. ডি. পির নূরুল আমিন অপরটি স্বতন্ত্র পার্টির চাকমা রাজা ত্রিবিদ রায়। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭০.৪৮% ভোট এবং ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি লাভ করে। অবশিষ্ট ১২টি আসনের মধ্যে পি.ডি.পি ২টি, ন্যাপ ১টি, জামায়াত ১টি, স্বতন্ত্র প্রার্থী ৮টি আসন পায়। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনের সবকয়টি লাভ করে আওয়ামী লীগ। ফলে ৩১৩ সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মোট ১৬৭টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত আসনের মধ্যে পি. পি. পি ৮৩টি, ন্যাপ ৬টি, মুসলিম লীগ কাইউম ৯টি, মুসলিম লীগ কাউন্সিল ৭টি, মুসলিম লীগ কনভেনশন ২টি, জামায়াত-ই-ইসলাম ৪টি, জমিয়াত-ই-উলামা- ই-পাকিস্তান ৭টি, জমিয়াতে-ই-উলামা ৭টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীগণ ১৪টি আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৬টি মহিলা আসনের মধ্যে পি. পি. পি. পায় ৫টি, ন্যাপ পায় ১টি আসন। উপর্যুক্ত আলোচনা অর্থাৎ তালিকায় দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রভাব : ১৯৭১ সালে যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা স্বাধীনতা লাভ করে তার পিছনে উৎসাহ ও প্রেরণা যোগায় ১৯৭০ সালের নির্বাচন। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৭০ এর নির্বাচনের প্রভাব নিচে আলোচনা করা হলো :
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদ : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে পি. পি. পি. একটি আসনও পায়নি কারণ বাঙালি জাতি অবাঙালিকে পছন্দ করে না। এছাড়া আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে ২৭ জন হিন্দু প্রার্থী দিয়েছিল। পূর্ব বাংলায় ৮৫% মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা বিজয়ী হয়, তাই বাঙালি জাতি জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭১ স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করে।
২. যোগ্য নেতৃত্ব : আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভূমিকা রাখেন। তিনি জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে জনগণ এ রায় দিয়েছে। এতে জনগণের মনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জায়গা করে নেয়। অতঃপর ১৯৭১ সালের বাঙালি জনগণ তার সাহসী নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
৩. স্বৈরশাসনের অবসান : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ।সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয় পাকিস্তানে সুদীর্ঘ ২৫ বছরে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসন ও অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে বাঙালি জাতির স্বাধীকার ও মুক্তিলাভেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
৪. স্বায়ত্তশাসন প্রতিজ্ঞা : ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয় মূলত ১৯৬৬ এর ছয়দফাভিত্তিক। আর ছয়দফার প্রথম দফা ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রদান। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচনই সর্বপ্রথম স্বাধীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালিরা সর্বপ্রথম আত্মপ্রতিষ্ঠার ও স্বশাসনের সুযোগ লাভ করে।
৫. ছয়দফা দাবি বাস্তবায়ন : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারে ছয়দফা কর্মসূচিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যার মৌলিক লক্ষ্য ছিল স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা। আর বাংলার আপামর জনসাধারণ এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পক্ষে রায় দেয়। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ত্বরান্বিত হয়।
৬. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : ১৯৭১ সালের দিকে আওয়ামী লীগই ছিল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। দেশের এই সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনে জনগণ নিঃশব্দ ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধিকারের স্বপক্ষে রায় দেয়। তাদের দাবির মূল লক্ষ্য ছিল দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সফল বাস্তবায়ন ঘটে।
৭. সংবিধান রচনা : আওয়ামী লীগের কর্মসূচির নির্ধারণ হয় নির্বাচনভিত্তিক। আর তার উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় সংবিধান। সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর দলীয় কর্মসূচির ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করা হবে বলে আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মসূচিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সিদ্ধান্তের কার্যকর রূপ প্রতিফলিত হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে। সে সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান রচনা করা।
৮. রাজনৈতিক ঐক্য গঠন : ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন বাঙালিদের ঐক্য জোরদার করে। স্বাধিকারের দাবিতে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে এবং তারা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠে। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এ রাজনৈতিক ঐক্য প্রেরণার ও শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। আর এ রাজনৈতিক ঐক্য থেকেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের
আগমনী বার্তা ধ্বনিত হয়।
৯. পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পরাজয় : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের উপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়, এতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পরাজিত হয়। এতে তারা পূর্ব বাংলা ছাড়তে বাধ্য হয়। এ নির্বাচনের মাধ্যমেই বাঙালিরা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং সর্বশক্তি নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে।
১০. পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন : বিশ্বের এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে দুই ভূখণ্ডের মাঝখানে অন্য একটি রাষ্ট্র অবস্থিত। এছাড়া দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ছিল বিশাল ব্যবধান। এতে পাকিস্তানের ভাঙন প্রায় নিশ্চিত ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির পরাজয় নিশ্চিত করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন। এ নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া সরকার কোনো সদিচ্ছা ব্যক্ত করেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলেও ইয়াহিয়া খান সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভরাডুবি হয়।
১১. মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা : ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মূল প্রেরণা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে পূর্ব বাংলার আপামর জনগণের মাঝে। তারা স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে একটুও দ্বিধাবোধ করেনি। মূলত ‘৭০-এর নির্বাচনই তাদের প্রেরণা যোগায়।
১২. বাংলাদেশের জন্ম : ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশ রাষ্ট্র উত্থাপনের মাধ্যমে। আওয়াম ী লীগের পতাকাতলে তথা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং আপামর জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে
অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি জনগণের জাতীয়তাবোধ চেতনার পক্ষে রায় প্রতিফলিত হয়। বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আর এ কারণেই বলা হয়, বাংলাদেশের জন্ম হতো না যদি ৭০ এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হতো। ‘৭০ এর নির্বাচন বাংলার জনগণের মাঝে মূল প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।