অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি প্রচারমাধ্যমের গুরুত্ব বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলোর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর নির্বিচারে যে গণহত্যা শুরু করে তার বিরুদ্ধে বিদেশি
প্রচারমাধ্যমগুলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বহির্বিশ্বে জনমত গঠন করে। শরণার্থী সমস্যা এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা, বৃহৎ শক্তি ও জাতিসংঘকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে বিদেশি গণমাধ্যম সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিদেশি গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকার ফলে বিদেশে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন প্রদান ও সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা : ঢাকাসহ সমগ্র দেশে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ লাখো মানুষকে হত্যা করা হয়; নির্বিচারে ধ্বংস করা হয় অসংখ্য জনপদ। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা সাইমন ডিং-এর প্রতিবেদনে সর্বপ্রথম বিশ্ববাসী গণহত্যা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিল। নিচে বিদেশি গণমাধ্যমের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. মার্কিন গণমাধ্যমের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ও প্রচার মাধ্যমগুলো এবং সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয় এবং দেশের ভিতরে জনমত গঠন করে মার্কিন সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, বাল্টিমোর সান, টাইম নিউজউইক প্রভৃতি গণমাধ্যমগুলো গণহত্যা, নির্যাতন, শরণার্থী সমস্যার উপর প্রতিবেদন লিখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করে। উদাহরণস্বরূপ কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শিরোনামে শিল্পী জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর নিউইয়র্ক ম্যাডিসনে সংগীত আয়োজন করে জনমত গঠন করেছিল।
২. যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমের ভূমিকা : যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমগুলো মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে জনমত গঠন করে তোলে। যুক্তরাজ্যের বিবিসির বাংলা বিভাগ ছিল বাঙালি বন্ধুর মতো। ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ, প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছিল। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। ম্যাগাজিন বিবিসির প্রভাতী অধিবেশনে স্বাধীনতা ঘোষণাটি প্রচারিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দি টাইমস’ এবং ‘দি গার্ডিয়ান’ নামক বিখ্যাত পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা প্রকাশিত হয়। ব্রিটেনের গণমাধ্যমেগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে গণহত্যা, শরণার্থী সমস্যা, যুদ্ধের যৌক্তিকতা, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে প্রকৃত অবস্থার খোঁজখবর পাওয়া যেত।
৩. লন্ডন উইক অ্যান্ড টেলিভিশন : ব্রিটেনে জনমত গঠনে যুক্তরাজ্যের এ টেলিভিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১১ জুন, ১৯৭১ সাল থেকে বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছাড়াও ৩ জন ব্রিটিশ নাগরিক অংশ নেয় । অনুষ্ঠানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন।
৪. ভারতীয় প্রচারমাধ্যম : মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। ভারতীয় গণমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমগুলোর ইতিবাচক ভূমিকাই বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্থান টাইমস প্রভৃতি পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করে। আকাশবাণী কলকাতা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্র
চারমাধ্যম। কলকাতা কেন্দ্র বাংলা খবর, সংবাদ বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, কথিকা, অবরুদ্ধ বাঙালি প্রভৃতি অনুষ্ঠান প্রচার করত। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে যে সকল নিয়মিত, অনিয়মিত ও গেরিলা বাহিনী জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করত তাদের সঠিকভাবে উৎসাহ প্রদান ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল।
সমর্থন আদায় : বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলো নিয়মিত পাকবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, লোমহর্ষক কাহিনি, ধর্ষণ, গণহত্যা, শরণার্থীদের দুর্দশার খবর প্রচার করে জনমত গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায় করেছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলোর অবদান ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হত্যা প্রভৃতির ফলে যে জনমত গড়ে উঠে তার পিছনে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমের কল্যাণে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের পক্ষে অবস্থান ও জনমত গড়ে উঠে।