অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৪৬ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির উদ্ভবের পর হতেই পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার উপর শুরু করে ঔপনিবেশিক শাসন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের কায়েমি স্বার্থরক্ষার জন্য বাঙালি জাতিকে দমন করতে শুরু করে। তারা সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করে। কিন্তু বাঙালি জাতি এসব বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলে এবং স্বাধীনতা অর্জন করে। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পরিচিতি : রাজনীতির দাবা খেলায় বার বার পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ হয়েছে নিষ্পেষিত ও বঞ্চিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হওয়া সত্ত্বেও তারা ন্যায়সংগত ও ন্যায্য অধিকার পায়নি। ফলে বাঙালি জাতি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিচে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পরিচিতি বর্ণনা করা হলো :
১. বিদ্রোহী জাতি : বাঙালি জাতির অতীত ঐতিহ্যময় ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে বাঙালি জাতি অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদ করে এসেছে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল বঙ্গ প্রদেশ। বাঙালিরা সর্বদা স্বাধীনচেতা। তেমনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য ও অবিচারের প্রতিবাদ করেছে দৃঢ়ভাবে। ঐতিহাসিক ইবনে বতুতা বাংলাকে “নিয়ামতপূর্ণ দোযখ” নামে অভিহিত করেছেন। কাজেই স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালি ছিল আপসহীন।
২. দ্বিজাতিতত্ত্ব : ঐতিহাসিক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে পাকিস্তানের জন্ম হয় তার মূল উৎস ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। কিন্তু বাঙালি জাতি মুসলিম হবার চেয়ে বাঙালি হওয়ার দিকে বেশি মনোযোগী হয়। দ্বিজাতি তত্ত্ব বাঙালিরা মেনে নেয়নি ফলে ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে।
৩. বুর্জোয়া শ্রেণির প্রভাব : পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বুর্জোয়া শ্রেণিতে পরিণত হয়। বুর্জোয়া শ্রেণি পূর্ব বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে চরমভাবে শোষণ শুরু করে। এর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি ন্যায্য অধিকার ও দাবি আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হয়।
৪. আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা : পাকিস্তানে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের দাবিদাওয়া পেশ করার একটি সূদৃঢ় প্লাটফর্ম। মুসলিম লীগ শুরু থেকেই যে স্বৈরাচারী শাসন শুরু করে, তারই প্রতিরোধ হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্ম। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে আওয়ামী লীগ দলের রয়েছে একক নেতৃত্ব।
৫. সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অগ্রাহ্য করা : পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করতে থাকে, ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ এবং পরবর্তী সামরিক শাসকগণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মতামতে গুরুত্ব দেয়নি। যেমন- ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত ফজলুল হক এর প্রাদেশিক সরকারকে ২ মাসের মধ্যে বরখাস্ত করে এবং ১৯৭০ নির্বাচনে ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা শুরু করে। যা বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৬. যুক্তফ্রন্টের বিজয় : ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার প্রতি বাঙালি জনতা সমর্থন প্রদান করেন কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা মেনে নেয়নি। যা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনে উৎসাহিত করে।
৭. ভাষা আন্দোলন : বাঙালি জাতিকে দমন করার জন্য পশ্চিমা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সর্বপ্রথম বাঙালির ঐক
মত্যে আঘাত আনতে সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে উদ্যোগী হয়। ভাষার উপর আঘাত আসে পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল বের করলে অনেক লোক হতাহত হয়। এর ফলে সৃষ্ট জাতীয়তাবোধ বাংলাদেশ সৃষ্টিতে মূল ভূমিকা পালন করে।
৮. সামরিক আগ্রাসন : পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে সামরিক শাসন বজায় ছিল। সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের উপর বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে জেনারেল আইয়ুব খান পূর্ব বাংলার উপর আগ্রাসন শুরু করে, ফলে বাঙালিরা গণআন্দোলন শুরু করে। এটি বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের অন্যতম কারণ।
৯. ছয়দফা কর্মসূচি : ছয়দফা কর্মসূচি ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। ছয়দফা ছিল বাঙালির অধিকার ও ন্যায্য পাওনা আদায়ের দাবি। ছয় দফা ছিল বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক মুক্তির সনদ। ছয়দফাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন শুরু হয় তা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল ।
১০. গণঅভ্যুত্থান : ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা দায়ের করলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছয় দফা দাবি ও আগরতলা মামলার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে এবং আইয়ুব খানের পতন ঘটে।
১১. ৭০ এর নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তান ভাঙনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে দীর্ঘসূত্রিতা শুরু করে। এটি পরে অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়।
১২. অসহযোগ আন্দোলন : ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ বাঙালি জাতির উপর আক্রমণ শুরু করলে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয় এবং বাঙালি জাতি মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত হয়।
১৩. মুজিবনগর সরকার : মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও বৈদেশিক সমর্থন লাভের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।
১৪. বাংলাদেশের উদ্ভব : স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব ছিল বাঙালির জাতীয় জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ ও অহংকারের ঘটনা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনা ছিল বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের ত্যাগতিতিক্ষা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। বহু আন্দোলন ও সংগ্রামের ফলে প্রাপ্ত এ স্বাধীনতা বাঙালির জাতীয় জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। সৃষ্টি হয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।