গ্রামীণ শ্রেণি কাঠামো সম্পর্কিত মাকর্সীয় তত্ত্ব বিশ্লেষণ কর।

অথবা, গ্রামীণ শ্রেণি কাঠামো সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গ্রামীণ শ্রেণি কাঠামো সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বটি সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, গ্রামীণ শ্রেণি কাঠামো সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বটি বিস্তারিত তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানে শ্রেণি হচ্ছে সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল। এ ধারণানুযায়ী শ্রেণি হলো সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থা দ্বারা নির্ধারিত বৃহৎ এক জনগোষ্ঠী যাদের উৎপাদনযন্ত্রের সাথে কোনো না
কোনোভাবে সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যায় এবং উৎপাদনের কাজে তাদের ভূমিকা ও মজুরির ভিত্তিতে এবং তাদের দখলে রয়েছে এমন সম্পদের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা যায়। গ্রামীণ কৃষি কাঠামোর ক্ষেত্রে শ্রেণি প্রত্যয়টি মার্কস কিভাবে ব্যবহার করেছেন তথা গ্রামাঞ্চলে বিরাজমান শ্রেণি কাঠামো বুঝার জন্য ঐতিহাসিক উৎপাদন ব্যবস্থাগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন ।
গ্রামীণ শ্রেণি কাঠামো সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্ব (Marxist theory of rural class structure) :
সামাজিক শ্রেণি প্রত্যয়টির সাথে কার্ল মার্কসের নাম ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, কেননা, শ্রেণি প্রত্যয়টির প্রবক্তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। সমাজের শ্রেণি কাঠামো গড়ে উঠে সমাজের সকল শ্রেণি ও গোষ্ঠী, তাদের সম্পর্ক বিন্যাস এবং বিভিন্ন সামাজিক স্তরকে নিয়ে। সমাজে বিরোধমূলক উৎপাদন পদ্ধতি থাকলে পরস্পরবিরোধী শ্রেণিও থাকবে। কারণ সংশ্লিষ্ট উৎপাদন পদ্ধতিই সমাজকে শ্রেণিবিভক্ত করে। মার্কসীয় তত্ত্ব বা ধারণা অনুসারে বৈষম্যমূলক বা রিরোধমূলক সমাজ মাত্রেই হলো শ্রেণিবিভক্ত ও শ্রেণি শাসিত
সমাজ। এ ধরনের সমাজে সবসময়ই দু’ধরনের শ্রেণি থাকে। এ দু’ধরনের শ্রেণি হলো : মুখ্য শ্রেণি (Basic class) ও
গৌণ শ্রেণি (Non-basic class ) ।
মুখ্য শ্রেণি (Basic class) : মার্কসবাদীদের মতানুসারে শ্রেণিবিভক্ত সকল সমাজে দু’টি মুখ্য শ্রেণি থাকে। উৎপাদন পদ্ধতি বা ব্যবস্থার মধ্যে যে বিরোধ বর্তমান থাকে, তা মুখ্য দু’টি শ্রেণির পারস্পরিক সম্পর্ক ও সংগ্রামের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মার্কসের আলোচনায় দেখা যায় যে, কৃষিকর্মকাণ্ডে যুক্ত শ্রেণিসমূহের গঠন ও আন্তঃসম্পর্ক উৎপাদন ব্যবস্থা,
পরিবর্তনের সাথে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন- দাসব্যবস্থা ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষুদে কৃষক, ভূমিদাস, ভূস্বামী ইত্যাদি গ্রামীণ সমাজকাঠামোর অন্যতম অংশ ছিল। ক্ষুদে কৃষকের অস্তিত্ব দাস উৎপাদন ব্যবস্থা আসার আগেই দেখা যায় এমনটি মার্কস ‘Pre-capitalist Socio-economic Formation’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, “ঋণগ্রস্ততার মধ্যদিয়ে ক্ষুদে কৃষক একই পর্যায়ে দাসে রূপান্তরিত হয়েছিল প্রাকধনতান্ত্রিক মহাজনের কাছে। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ভূমি তথা কৃষির কেন্দ্রীয় গুরুত্বের সাথে সাথে ভূমিদাস ও ভূমিস্বামীর আবির্ভাব। তবে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোতে ও ক্ষুদে কৃষকদের উপস্থিতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গৌণ শ্রেণি (Non-basic class) : গৌণ শ্রেণি উত্তরণশীল শ্রেণি হিসেবেও পরিচিত। সমাজে গৌণ শ্রেণির সংখ্যা বহু ও বিভিন্ন হয়ে থাকে। দাস সমাজে দরিদ্র কৃষক, কারুশিল্পী প্রভৃতি গৌণ শ্রেণি থাকে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নতুন

ণিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব, কারিগর ও হস্তশিল্পী নিয়ে গঠিত শ্রেণিও থাকে। এছাড়া ধনতান্ত্রিক সমাজে অন্যান্য গৌণ শ্রেণি থাকে, যেমন— ছোটখাট সম্পত্তির মালিক, ব্যবসায়ী, কারিগর, কৃষক, কারুশিল্পী প্রভৃতি ।
ভূমিহীন শ্রেণির বিকাশ : পুঁজিবাদী সম্পর্ক প্রসারের ফলে গ্রামীণ কৃষি কাঠামোয় নতুন শ্রেণির বিকাশ ঘটে। ভূমিহীন শ্রেণির বিকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ শ্রেণিটি শ্রম বিক্রি করে জীবিকানির্বাহ করে।
কৃষিক্ষেত্রে শ্রেণি কাঠামো : ভূমিহীন শ্রেণির পাশাপাশি অন্যদিকে, বিকশিত থাকে ধনী কৃষক যারা ক্রমাগত বাজারের জন্য
উৎপাদনে জড়িয়ে পড়ে । ধনী কৃষকের হাতে পুঁজির সঞ্চয়ন হয় এবং তা প্রভাবিত করে জমির বণ্টন বিন্যাসকে। কাল কৃষিতে ধনতন্ত্র বিকাশলাভ করার ক্ষেত্রে কিছু বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন মাঠে অবস্থিত একাধিক খণ্ড জমির কেউ মালিক হতে পারেন, কিন্তু তাতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হয়। যেমন- চাষাবাদ তদারকি (Supervision) ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ ও সমস্যাকীর্ণ হতে পারে। উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রাক ধনতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ধনতান্ত্রিক সম্পর্ক একই সাথে বিরাজ করাতে শ্রেণি কাঠামো পর্যালোচনা করা বেশ কিছুটা জটিলতা ধারণ করেছে। মার্কসবাদী লেখক লেনিন একটি ধনতান্ত্রিক কৃষি কাঠামোয় ছয়টি শ্রেণির কথা উল্লেখ করেছেন। এরা যথাক্রমে; সর্বহারা, আধা সর্বহারা বা অতিক্ষুদ্র কৃষক, ছোট কৃষক, মধ্য কৃষক, বড় কৃষক এবং মজুরি, শ্রম শোষণকারী বড় জমির মালিক। প্রথম তিনটি শ্রেণি একটি ধনতান্ত্রিক কৃষি সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে বিরাজ করে। নিম্নে এসব শ্রেণি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. সর্বহারা শ্রেণি : এরা সম্পূর্ণরূপে শ্রম বিক্রি করে জীবিকানির্বাহ করে।
২. আধা সর্বহারা : আধা সর্বহারা বা অতি ক্ষুদ্র কৃষক শ্রেণিটি একদিকে শ্রম বিক্রি করে, অন্যদিকে নিজের অতি অল্প.জমি বা অন্যের কাছ হতে প্রাপ্ত জমিতে চাষাবাদ করে ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে।
৩. ছোট কৃষক : ছোট কৃষক নিজের বা অন্যের জমি চাষ করে বেঁচে থাকে এবং বাইরে শ্রম বিক্রি করে না।
৪. মধ্য কৃষক : মধ্য কৃষক শ্রেণি নিজের এবং অন্যের জমি চাষ করে এবং যে বছরগুলো ভালো ফসল হয়, সে সময়ে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি সহজ হয়। তবে এরা চাষাবাদের জন্য মজুর শ্রমিকও নিযুক্ত করে থাকে ।
৫. বড় কৃষক : বড় কৃষককুল রীতিমত পুঁজিবাদী কায়দায় ব্যাপক হারে মজুর শ্রমিক নিয়োগ করে উৎপাদন কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করে। তবে সাংস্কৃতিক মানের সরলতা ও কৃষিকাজে নিজের শ্রম প্রয়োগের ফলে ‘কৃষক’ নাম অক্ষুণ্ণ থাকে।
৬. বড় জমির মালিক : এ শ্রেণি প্রচুর জমির মালিক ও চাষাবাদ সম্পূর্ণ মজুর শ্রমিক দিয়ে পরিচালিত করে। নিজের জমি বর্গাতেও দিয়ে দেয় এরা।
অনগ্রসর কৃষি কাঠামোর জন্য মা-ও-সে-তুং পাঁচটি শ্রেণির কথা বলেছেন। এগুলো যথাক্রমে, শ্রমিক শ্রেণি, দরিদ্র কৃষক,
মধ্য কৃষক, ধনী কৃষক ও ভূস্বামী শ্রেণি । ভূস্বামীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা প্রধানত খাজনা শোষণ করে টিকে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, মার্কসীয় ধারণায় উৎপাদনের উপকরণ যদি সামাজিক মালিকানায় থাকে, তবে সেখানে সামাজিক সম্পর্ক হয় সহযোগিতার ও কল্যাণের। অপরপক্ষে, উৎপাদনের উপকরণ যদি ব্যক্তি মালিকানার থাকে, তবে সেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের সম্ভাবনা প্রচুর। এ মালিকানা এবং সম্পর্কের ভিত্তিতেই গড়ে উঠে সামাজিক শ্রেণি ৷ অর্থনীতি গ্রামীণ সমাজ জীবনে ব্যাপক হয়ে পড়ার অবশ্যম্ভাবী ফলরূপে দেখা যায় যে, এক শ্রেণির মানুষ অপর শ্রেণির মানুষ হতে আলাদা । মার্কসের মতানুসরীরাও আর্থিক প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ শ্রেণি কাঠামো ব্যাখ্যার প্রয়াস পেয়েছেন।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b8%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%80%e0%a6%a3-%e0%a6%b8%e0%a6%ae/